বিশ শতকে এ দেশের বিজ্ঞানচর্চা বিশ্বমানে পৌঁছে গিয়েছিল। জগদীশ বসু, সত্যেন বোস কিংবা মেঘনাদ সাহাদের কথাই ধরুন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁরা গোটা বিশ্বেই পথপ্রদর্শক। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিজ্ঞানের আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি এ দেশে। তারপর দেশভাগ, উত্তাল রাজনীতি, স্বাধীনতা পেরিয়ে সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানচর্চার হাতেখড়ি হয় এ দেশের তরুণ সমাজের। সে ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন আবদুল্লাহ আল–মুতী, আবদুল জব্বার, এ এম হারুন অর রশীদ ও আলী আসগরের মতো অধ্যাপক ও লেখকেরা। এঁদের সবাই বিজ্ঞানের নামকরা শিক্ষক ছিলেন। কেউ সরাসরি অধ্যাপনা করে, কেউ বিজ্ঞানবিষয়ে লিখেই এ দেশের বিজ্ঞান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক ড. আলী আসগর। তিনি যেমন অধ্যাপনা করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানের আলো জ্বেলেছেন, বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে এ দেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বক্তৃতা দিয়ে, রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমেও বিজ্ঞানের প্রসারে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এই অগ্রপথিকের লেখা অন্যতম সেরা বই হলো বিজ্ঞান আন্দোলন। এ বইয়ে বিজ্ঞানকে শুধু বিজ্ঞান আর গণিতের কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং বিজ্ঞানের দার্শনিক দিকগুলো যেমন তুলে এনেছেন সিন্ধু সেঁচে তোলা মুক্তার মতো করে, তেমনি গভীরভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন বিজ্ঞানের ভাবনাগুলো। বিজ্ঞান জানা বা পড়া যতটা জরুরি, বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে নিজেকে, সমাজকে গড়ে তোলা তার চেয়ে বেশি জরুরি। মূলত এটাই বিজ্ঞান আন্দোলন বইয়ের মূলভাব।
বইটি ১৩টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। বইটি শুরুই হয়েছে বিজ্ঞানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী, তা নিয়ে। বিজ্ঞান শেখা কেন জরুরি, সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রথম অধ্যায়ে। পরের অধ্যায়েই আবার আলোচনা করা হয়েছে বিজ্ঞান আসলে কী, এ বিষয়ে। অনেকেই বিজ্ঞান পড়ি, মুখস্থ করি, কিন্তু আত্মস্থ করি না। এতে আসলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। আর বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করতে বিজ্ঞান কী, কীভাবে বিজ্ঞান কাজ করে, বিজ্ঞান পড়ে কীভাবে আনন্দ লাভ করা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়েই এগিয়েছে বইয়ের লেখা।
এখন যে বিজ্ঞান ও গণিতের অলিম্পিয়াডগুলো নিয়ে এত উন্মাদনা চলছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিজ্ঞান ক্লাব, এই শুভ উদ্যোগগুলোর প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিলেন অধ্যাপক আলী আসগর। তাই বিজ্ঞান ক্লাব, বিজ্ঞান প্রজেক্ট ও বিজ্ঞান সপ্তাহ নিয়ে তিনটি অধ্যায় সংযুক্ত করেছিলেন বিজ্ঞান আন্দোলন বইটিতে। বিজ্ঞান যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক জীবন ও বাস্তবতার সঙ্গে বিজ্ঞান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সে নিয়েও কলম ধরেছিলেন লেখক। বোঝাতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞান–সংস্কৃতির গুরুত্বও।
সহজ ও সাবলীল ভাষায় বিজ্ঞান লেখা, সেগুলোর মূলে প্রবেশ করানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল অধ্যাপক আলী আসগরের। সেই মুনশিয়ানারই এক পরিণত উদাহরণ বিজ্ঞান আন্দোলন বইটি। ৯৬ পৃষ্ঠার ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ বইটি পাওয়া যাবে দেশের সব অভিজাত বুক শপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।