গল্প-কমিকসে প্রাণরসায়নে হাতেখড়ি

জীবদেহের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত নানা রকম রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটছে। এমনকি ঘুমিয়ে থাকলেও এসব ক্রিয়া-বিক্রিয়া থেমে থাকে না। জীবদেহের এসব জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার সঙ্গে প্রাণের যে সম্পর্ক, তা নিয়ে আলোচনা করে বায়োকেমিস্ট্রি বা প্রাণরসায়ন। এটি মূলত জীববিজ্ঞান ও রসায়নের মেলবন্ধন। চিকিৎসাশাস্ত্র, ফার্মাকোলজি, কৃষি, পুষ্টিবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার জন্য প্রাণরসায়নের মৌলিক কিছু বিষয় জানা জরুরি। তবে এত দরকারি একটা বিষয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয়টা খুব সুখকর হয় না।

সদ্য মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকে ওঠা শিক্ষার্থী কিংবা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সামনে জুজু হিসেবে ধরা দেয় প্রাণরসায়ন! তবে জটিল এ বিষয়টি যে একেবারেই সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করা যায় না, তা নয়। প্রাণরসায়নের জগৎটাও যে মজার হতে পারে, গল্প আর কমিকসের মাধ্যমেও যে বায়োকেমিস্ট্রি শেখা যায়, তা বুঝতে হলে পড়তে হবে দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি। লিখেছেন জাপানিজ লেখক ও গবেষক মাসাহারু তাকেমুরা। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসসহ নানা বিষয় সহজবোধ্য উপস্থাপনের জন্য জাপানি ভাষায় লেখা হয়েছে ‘মাঙ্গা গাইড’ সিরিজ। এই সিরিজের বই দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন লেখক ও অনুবাদক সুজয় কুমার দাশ।

এই বইয়ে জটিল সব সংকেত ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার চক্র কমিকসের মাধ্যমে সহজে উঠে এসেছে। কথোপকথনের ভঙ্গিমার সঙ্গে ধাপে ধাপে সচিত্র ব্যাখ্যা জীবন্ত করে তুলেছে বিষয়গুলোকে। বইটির প্রধান চরিত্র কুমি নামে এক হাইস্কুল পড়ুয়া মেয়ে। সে তার খাদ্যাভ্যাস নিয়ে খুব চিন্তিত। ওজন কমানোর তাড়নায় প্রাণরসায়নের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি তার ভালো লাগা তৈরি হয়। এই কৌতূহল মেটাতে সামনে আসে নেমোটো নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে ও তার শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক চোকো কুরুসাকা। এই তিনজনের কথোপকথনে কমিকসের মাধ্যমে বায়োকেমিস্ট্রির নানা বিষয় উঠে এসেছে বইটিতে।

ক্রমশ কুমির প্রতি নেমোটোর ভালো লাগা তৈরির একটা গল্প ফাঁদার চেষ্টা করেছেন লেখক। তবে প্রাণরসায়নের নানান আলোচনায় সে গল্প প্রাধান্য পায়নি কখনোই। আর এতে প্রাণরসায়নের জটিল সব বিষয়ের আলোচনাও অনেকটা ছন্দময়ভাবে এগিয়েছে। একঘেয়ে লাগার অবকাশ ছিল খুব কম। কমিকসের বই হলেও প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর বর্ণনা ও ব্যাখ্যা রয়েছে। 

প্রাণরসায়নের নানা বিক্রিয়া ঘটার রঙ্গমঞ্চ হিসেবে কাজ করে আমাদের দেহের কোষগুলো। কোষের মধ্যে যেসব কলকব্জা রয়েছে ও দেহের ভেতর প্রতিনিয়ত যেসব রাসায়নিক যজ্ঞ ঘটে চলেছে, তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে বইয়ের শুরুতে।

পরের অংশে রয়েছে সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসনের বিভিন্ন ধাপের বিস্তারিত বর্ণনা। এ দুই প্রক্রিয়ার নানা চক্রের ধাপও উঠে এসেছে বইতে। শর্করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পাশাপাশি এটিপি কী, একে কেন শক্তিমুদ্রা বলা হয়, সে সবের উত্তরও পাওয়া যাবে। 

তৃতীয় অধ্যায়টি বেশ উপভোগ্য। আগের দুই অধ্যায়ে প্রাণরসায়নের মৌলিক কিছু বিষয়ে জানার পর এখানে দৈনন্দিন জীবনে প্রাণরসায়নের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লিপিড, ফ্যাটি অ্যাসিড ও কোলেস্টেরলের নানা বর্ণনার পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এখানে। আমাদের শরীরে কেন চর্বি জমে, রক্তের গ্রুপ এল কেমন করে, পাকা ফল কেন মিষ্টি হয়—এমন নানা প্রশ্নের প্রাণরাসায়নিক উত্তর নিয়ে এ অধ্যায়।

এরপরের অংশে রয়েছে প্রোটিন ও এনজাইম সম্পর্কে আলোচনা। লেখচিত্রের সাহায্যে এনজাইমকে জানা ও বাস্তবে এর ব্যবহার নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এখানে। 

একনজরে

দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি 

লেখক: মাসাহারু তাকেমুরা

অনুবাদ: সুজয় কুমার দাশ

প্রকাশক: অন্বেষা প্রকাশন

প্রচ্ছদ: মূল কভার অনুযায়ী 

পৃষ্ঠা: ২৬৪

মূল্য: ৮০০ টাকা

বইটির শেষে নিউক্লিক এসিড, জিন, ডিএনএ, আরএনএ, রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ক্রোমাটোগ্রাফি, ইলেকট্রোফোরেসিস, সেন্ট্রিফিউগেশনের মতো নানা প্রাণরাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বর্ণনা।

বইয়ের লেখক নিজে প্রাণরসায়নবিদ। তাই তাঁর নিজের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার গল্পও উঠে এসেছে বইতে। মজার বিষয়, বইটির অনুবাদকও একজন প্রাণরসায়নের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় বিজ্ঞান ঘরানার লেখালেখি করছেন তিনি। কমিকস বই অনুবাদ করা বেশ পরিশ্রমের কাজ। তার ওপর আবার প্রাণরসায়নের কমিকস! পুরো বইয়েই অনুবাদক সুজয় কুমার দাশের অনুবাদ ছিল সাবলীল। পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়নি কখনো। কমিকসের ছোট ছোট সংলাপের পাশাপাশি প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষ অংশটুকুও বেশ প্রাঞ্জল।

 তবে বইয়ে বেশকিছু মুদ্রণত্রুটি চোখে পড়েছে। বইয়ের অন্যতম চরিত্র ‘নেমোটো’। অথচ এই নামটি কখনো ‘নেমোটা’ ও বেশির ভাগ সময় ‘নেমেটো’ হিসেবে এসেছে। বইটির ১১৬ পৃষ্ঠায় একটি ছবিতে ‘এলডিএল’কে ভালো কোলেস্টেরল বলা হয়েছে। আসলে ভালো কোলেস্টেরল হলো ‘এইচডিএল’। ১৭০ পৃষ্ঠায় বেশ কয়েকটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের নামের বানানে ভুল রয়েছে।

একজন হাইস্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু যেকোনো পাঠকের জন্যই দারুণ উপভোগ্য হতে পারে দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি। চিত্রনির্ভর গল্প আর কমিকসে প্রাণরসায়নের এমন একটি বই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য দরকার ছিল। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে আরও একটুখানি উসকে দেবে বইটি। পাওয়া যাবে দেশের বিভিন্ন অনলাইন ও অফলাইন বুকশপে।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ