গল্পে গল্পে বিজ্ঞান শেখার বই

আশপাশের নানা বিষয় সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ থেকেই জন্ম বিজ্ঞানের। বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিক বিষয়। তবে সবাই যে অ্যাকাডেমিকভাবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। আবার আমাদের পাঠ্যবইগুলোতে সবকিছু সবিস্তারে থাকেও না। পৃষ্ঠার সীমাবদ্ধতা, শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীদের কোন বিষয়গুলো শেখা জরুরি—এরকম বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে সাজানো হয় পাঠ্যবই। এ কারণে অনেকের কাছে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো জটিল মনে হতে পারে।

যাঁরা বিজ্ঞান সহজভাবে বুঝতে চান—হোক তা বিজ্ঞানশিক্ষার্থীর পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতে ঢুঁ দেওয়া কিংবা অন্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহ—জনপ্রিয় ধারার বইগুলো তাঁদের জন্য সহায়ক হতে পারে। যেখানে থাকবে জটিল নানা সমীকরণের সহজ ব্যাখ্যা, থাকবে ইতিহাস। শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান দেখে ভয় পাবে না। বর্তমানে বাংলাভাষায় সেরকম অনেক বই আছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ প্রকাশিত তৌহিদুর রহমানের এই বই সে ধারায় চমৎকার এক সংযোজন।

সুবিদ হাসানের বিজ্ঞানবোধ বইটিতে মোট অধ্যায় আছে ২৯টি। নানা বিষয় নিয়ে সেসব অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এই বই বেশির ভাগ জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানের বই থেকে আলাদা। মূল উদ্দেশ্য এক হলেও উপস্থাপনের ধরন ভিন্ন।

বইয়ের মূল চরিত্র সুবিদ হাসান স্কুল শিক্ষক। ক্লাসে গিয়ে গল্প করেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, পড়ান। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের নানা বিষয় শেখান গল্পের ছলে।

বইয়ের মূল চরিত্র সুবিদ হাসান স্কুল শিক্ষক। ক্লাসে গিয়ে গল্প করেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, পড়ান। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের নানা বিষয় শেখান গল্পের ছলে। কোনো বিষয় না বুঝলে যেমন শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে প্রশ্ন করে, এই বইয়েও সেরকম কথোপকথন রয়েছে। একটা ক্লাসে যেহেতু বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের শিক্ষার্থী একসঙ্গে থাকে, তারা বিজ্ঞানের সব বিষয় সমানভাবে বোঝে না। আবার অনেকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হলেও একটু কম বোঝে। ফলে সুবিদ হাসানকে তারা নানা প্রশ্ন করে। সেগুলো ব্যাখ্যা করেন তিনি। প্রক্রিয়াটা বাস্তবে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তারা আলোচ্য বিষয় ভালোভাবে বুঝতে পারবে। সুবিদ হাসানের আলোচনা শুধু শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই নয়, বরং শিক্ষক, সহকর্মী, চায়ের দোকান—সবার মাঝে তিনি বিজ্ঞানের আলো ছড়ান।

কয়েকটা উদাহরণ দিই। শুরুর গল্পটা সুবিদ হাসানের ছাত্র রবিউলকে নিয়ে। সে মায়ের কাছে টাকা চেয়েছে। কিন্তু মা টাকা দিতে পারেননি। রবিউল তাই মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে স্কুলে। মা-ও থাকতে পারেননি। টাকা যোগাড় করে নিয়ে এসেছেন। কথাটা সুবিদ হাসানের কানে গেছে। ক্লাসে গিয়ে রবিউলকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সবটা। রবিউল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুবিদ হাসান তখন তাদের বোঝান, কীভাবে, কত কষ্ট করে মা তাকে জন্ম দিয়েছেন, বড় করেছেন। এই যে গল্পটা লেখক এখানে শুরু করেছেন, শেষ করতে করতে আপনি মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে বাচ্চার জন্ম নেওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা জানতে পারবেন। এর পেছনের বিজ্ঞানটা বুঝতে পারবেন অনায়াসে। মনেই হবে না বিজ্ঞানের কোনো বই পড়ছেন।

বছর দুয়েক আগে সংবাদ মাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল, চুয়াডাঙ্গার আমানত নামে একজন বলেছেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। বিষয়টা তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়। বিষয়টা নিয়ে লেখক একটা অধ্যায় সাজিয়েছেন। নাম, ‘মহাবিশ্ব পুরাটাই অস্থির’। এ অধ্যায়ে তিনি সূর্য ও সৌরজগতের গ্রহগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এক সময় মানুষ মনে করত, আসলেই পৃথিবী রয়েছে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে। সূর্যসহ অন্যান্য গ্রহগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। সেখান থেকে কীভাবে মানুষ সত্যিটা জানতে পারল, বুঝতে পারল সৌরজগতের আসল পরিচয়, তা উঠে এসেছে এ অধ্যায়ে।

একনজরে

সুবিদ হাসানের বিজ্ঞানবোধ

লেখক: তৌহিদুর রহমান উদয়

প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু

প্রকাশনী: অন্বেষা প্রকাশন

পৃষ্ঠা: ২০৭

মূল্য: ৪৭০ টাকা

শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি এ নিয়ে একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহী করতেও রাখতে পারে সহায়ক ভূমিকা।

আবার ধরুন, করোনা মহামারীতে আমাদের জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। সবার মাথায় একটাই প্রশ্ন তখন, বাজারে টিকা আসবে কবে? এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে করোনার টিকা কীভাবে কাজ করে, ইতিহাসের প্রথম টিকা কীভাবে আবিষ্কার হলো, সেসব। যেকোনো পরজীবীর টিকা আবিষ্কার করতে যে সেই পরজীবীর ভেক্টর লাগে, সে ব্যাপারটাই ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’ অধ্যায়ে খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে।

বইয়ে এ রকম মোট ২৯টি অধ্যায় আছে। জীববিজ্ঞান, মহাকাশ, আবহাওয়াবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, রসায়ন, জীবাশ্মবিদ্যা, গণিত ও শারীরতত্ত্বের নানা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে এসব অধ্যায়ে। বইটির ভাষা অত্যন্ত সাবলীল। বর্ণনাভঙ্গি চমৎকার, প্রশংসনীয়। তবে ছবিগুলো অনেক জায়গায় ঝাপসা হয়ে গেছে। ফন্ট ছোট হয়ে গেছে ক্যাপশনে, ঠিকভাবে দেখা যায় না—এমন। বানানও ভুল রয়েছে প্রচুর। সম্পাদনাতেও আরও খানিকটা যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিশোর উপযোগী এ ধরনের বইতে এ বিষয়গুলোর দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার।

বইটি লিখেছেন তৌহিদুর রহমান। বিজ্ঞান নিয়ে তিনি লেখালেখি করছেন অনেক বছর ধরে। ইতিমধ্যে তাঁর বেশ কিছু বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত। বইটি পড়লে তা নিজেই বুঝতে পারবেন পাঠক। স্কুল-কলেজশিক্ষার্থীদের জন্য বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি এ নিয়ে একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহী করতেও রাখতে পারে সহায়ক ভূমিকা। তা ছাড়া যেকোনো বয়সের মানুষই বইটি পড়তে পারবেন, হতাশ হতে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, বইটি পড়তে সবার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়াও বাধ্যতামূলক নয়।

চমৎকার এ বইটি প্রকাশ করেছে অন্বেষা। পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অফলাইন ও অনলাইন বুকশপে।