জাদুবাস্তব কল্পবিজ্ঞানের আশ্চর্য আলোয়

শ্যাতোয়ান্ত বইয়ের প্রচ্ছদ
একনজরে, শ্যাতোয়ান্ত, লেখক: দীপেন ভট্টাচার্য, প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ: ২০২৩, প্রচ্ছদ: অসিতোপল, পৃষ্ঠা: ২০৮, দাম: ৪২০ টাকা।

ইসাবেল সিমোনে একজন অভিনয়শিল্পী। মানুষটি যখন দুই মাত্রার বড় পর্দায় হাজির হন, কখনো দাপুটে গৃহবধূ, কখনো করপোরেট পেশাজীবী কিংবা দস্যুদের হাত থেকে পালাতে থাকা এক নারী—তাঁর আশ্চর্য সুন্দর দ্বিমাত্রিক সত্তা থেকে ফুটে বেরোয় অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা। সেই উজ্জ্বলতা শুধু আবু মাশারের চোখে পড়ে। তিনি ছুটে যান ইসাবেল সিমোনের সাক্ষাৎকার নিতে। সেই সাক্ষাৎকারে, কথোপকথনের একপর্যায়ে ইসাবেল সিমোনেকে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে গিয়ে মানুষটি নিজের একটি মাত্রা হারিয়ে ফেলেন। বন্দী হয়ে পড়েন দুই মাত্রার এক বিচিত্র জগতে—যে জগতে পর্দার ইসাবেলা সিমোনের বাস, যে জগৎ অতিমারি আক্রান্ত, যেখানে বদলে যায় বাস্তবতা। এই বদলে যাওয়া বাস্তবতা ফুটে ওঠে গল্পকথক অমলের ফেসবুকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি ছবিতে, যে ছবির কথা অমল নিজেও জানেন না। শুধু জানেন, আবু মাশার নবম শতাব্দীর পারস্যের এক জ্যোতির্বিদ, ইসাবেল সিমোনে দুই ফরাসি অভিনেত্রীর নামের সম্মিলন আর লেখকের বর্তমান হয়ে যায় পাঠকের ভবিষ্যৎ।

অর্থাৎ এ গল্পগুলো আপনি আগেই পড়েছেন। হয়তো শান্তা পর্বতে, যেখানে অমলের নিজের পিছু ছুটে চলা এক প্রতিরূপের সঙ্গে দেখা হয়, হয়তো সেই ভ্রমণে অংশ নিয়েছিলেন আপনিও। হয়তো ভুলে গেছেন। কারণ, আপনিও এ মহাবিশ্বের রেফারেন্স ফ্রেম বা জড় কাঠামোয় বন্দী।

কল্পবিজ্ঞানের জগতে বড় পরিবর্তন এসেছে সময়ের হাত ধরে। এককালে শুধু সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানকে আলাদা করে ভাবা হতো—যে গল্প ভবিষ্যতের বিশ্বের কথা বলে, যেখানে সময় এগিয়ে গেছে অনেকখানি, বিজ্ঞান প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে, প্রভাব রেখেছে সভ্যতার গতিপথে, তুলে এনেছে ভবিষ্যতের চিত্র। কিন্তু এ জগতে বড় পরিবর্তন এসেছে। পুরো ঘরানা এখন একসঙ্গে বলা হয় স্পেকুলেটিভ ফিকশন। তাতে বিজ্ঞান আছে, কল্পনা আছে, ফ্যান্টাসি আছে, আছে জাদুবাস্তবতা ও অধিবাস্তবতার ছোঁয়া। দীপেন ভট্টাচার্যের শ্যাতোয়ান্ত তেমনি একটি বই।

শ্যাতোয়ান্ত বইয়ের প্রচ্ছদ

লেখকের ভাষ্যে, এই গল্পগুলো হয়তো আপনি আগে পড়েছেন, একাধিকবার, হয়তো ভুলে গেছেন, তবু স্বীকার করতেই হবে—লেখকের বর্তমান হয়ে ওঠে পাঠকের ভবিষ্যৎ। কল্পবিজ্ঞান ও অধিবাস্তবতার এই মিশেলে আপনি ঢুকে পড়বেন ঘোরগ্রস্তের মতো—দীপেন ভট্টাচার্যের ভাষা কাব্যিক, হয়তো একটু জড়িত মনে হতে পারে, তাই একটু কাঠিন্য টের পেতে পারেন কেউ কেউ, কিন্তু গল্পগুলোর শেষে গিয়ে তীব্র আক্ষেপ আপনাকে ভাবাবে নিঃসন্দেহে। আপনি লেখকের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারেন, সুদূর জাপানে, যেখানে মনোনকে এক্সপেরিমেন্টের ফলে অশরীরী অস্তিত্বরা ঘুরে বেড়ায় কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরে বিমান ভ্রমণে, যেখানে অকারণে গুলি চালায় কেউ, তিনতলার কাচের জানালা ভেঙে লাফ দিয়েও অক্ষত রয়ে যায় মানুষ। এই অধিবাস্তবতা, সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক কার্যকারণে, ঘোরগ্রস্ত ভাষায় আপনি টের পাবেন, মণির মতো এক আলোক উৎস থেকে হলদে-সবুজ, বিড়ালের চোখের মণির মতো আলো—শ্যাতোয়ান্ত আপনাকে হাতছানি দিচ্ছে, দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখায়।

কল্পবিজ্ঞানের এই জাদুবাস্তব জগতে ভ্রমণে আগ্রহীদের জন্যই শ্যাতোয়ান্ত। লেখক দীপেন ভট্টাচার্য নিজে জ্যোতিঃপদার্থবিদ। তাঁর বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা টের পাওয়া যাবে গল্পগুলোয়। পাওয়া যাবে অনলাইন ও অফলাইন বুকশপগুলোতে।