এক অভাগা গণিতবিদের গল্প

একটি কাগজ কল্পনা করুন, যার শেষ নেই। অসীম। চারদিকে প্রসারিত। শুধু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, উচ্চতা বা গভীরতা নেই। এ রকম কাগজের ওপর কিছু জ্যামিতিক আকৃতি আঁকা। তবে সেগুলো এক জায়গায় স্থির থাকে না। ঘুরে বেড়ায় নিজের পছন্দ মতো। তবে শুধু সামনে-পেছনে যেতে পারে, ওপরে বা নিচে নয়। ওর ওপরেই তাদের ঘরবাড়ি, পরিবার নিয়ে বাস। এমন একটি দারুণ ঘটনা নিয়ে লেখা হয়েছে একটি কল্পগল্প। গাণিতিক কল্পগল্প। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। গাণিতিকি কল্পগল্প ফ্ল্যাটল্যান্ডে আপনাকে স্বাগতম।

এই সায়েন্স ফিকশনটি লেখা হয়েছে আজ থেকে ১৪০ বছর আগে, ১৮৮৪ সালে। এটি ক্লাসিক ও বিদ্রূপাত্মক ঘরনার বই। গল্পের পাশাপাশি উঠে এসেছে আঠারো শতকের ব্রিটিশ সমাজের চিত্র। নারীদের তখন খুব নগণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পাশাপাশি তাদের মধ্যে ছিল শ্রেণিবিভাজন। দাস ব্যবসা তখন চূড়ান্তে। নিম্নশ্রেণির কোনো মানুষের পক্ষে উচ্চশ্রেণিতে উন্নতি করার সুযোগ ছিল না। নারীরা তাদের মধ্যে অন্যতম। এই বইয়ে সেই ব্যাপারগুলো খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। একটু উদাহরণ দিলে আরও ভালো বুঝবেন। 

উদাহরণে যাওয়ার আগে বলি, বইটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে ১২ চ্যাপ্টার, আর দ্বিতীয় ভাগে ১০। প্রথমভাগে ফ্ল্যাটল্যান্ডের প্রকৃতি, ঘরবাড়ি, সেখানকার অধিবাসী; বিশেষ করে নারীদের কথা বলা হয়েছে। তারা কীভাবে একে অন্যকে চেনে, সে বিশ্বের আইনকানুন কী—এসব বিষয় উঠে এসেছে প্রথম ভাগে। আর দ্বিতীয় ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে অন্যান্য বিশ্ব সম্পর্কে।

সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের পরিবারে অনেক সময় সমবাহু ত্রিভুজ জন্মে। অনেক সময় অপারেশন করে সমবাহু ত্রিভুজ বানিয়ে নেওয়া হয়।

ফ্ল্যাটল্যান্ড আসলে একটি সমতল বিশ্ব। এই বিশ্বের সবাইকে বাহুর মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। যার বাহুর সংখ্যা যত কম, সে তত নিম্নস্তরের মানুষ। আর বাহুর সংখ্যা বেশি মানেই তার আধিপত্য অনেক। নারীরা এই বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নস্তরের। তারা সরলরেখা। এর ওপরের স্তরে রয়েছে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজেরা। তারা এ সমাজের সর্বনিম্নস্তরের পুরুষ। সমবাহু ত্রিভুজ সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের চেয়ে কিছুটা উন্নত এ সমাজে। এদের বাহু তিনটা হলেও কোণের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে শ্রেণি নির্বাচিত হয়। ত্রিভুজের চেয়ে বর্গ আরেক ধাপ ওপরে। এরপর পঞ্চভুজ, ষড়ভুজ…ইত্যাদি। বাহুর সংখ্যা এত বেশি যে আলাদা করাই যায় না—এদেরকে দেখায় বৃত্তের মতো। বলাও হয় বৃত্ত। তারাই সমাজে সর্বেসর্বা।

এই বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে একজন বর্গ। তিনি এই সমাজের একজন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান গণিতবিদ।

এখানে নিচু স্তর থেকে ওপরের স্তরে ওঠা কঠিন বটে, তবে অসম্ভব নয়। তবে এ সুযোগ শুধু পুরুষদের জন্য। যেমন বর্গের ছেলে হবে পঞ্চভুজ, আর নাতি হবে ষড়ভুজ। কিন্তু বর্গের কন্যা হবে সরলরেখা। তাদের উন্নতির কোনো সুযোগ নেই। তারা যেভাবে জন্মায়, সেভাবেই মৃত্যু হয়। অবশ্য সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের পরিবারে অনেক সময় সমবাহু ত্রিভুজ জন্মে। অনেক সময় অপারেশন করে সমবাহু ত্রিভুজ বানিয়ে নেওয়া হয়। তখন সমবাহু ত্রিভুজটিকে নিয়ে যায় সমাজের উচ্চশ্রেণির কোনো ত্রিভুজ বা বর্গ, যাদের সন্তান হয় না। 

এই সমাজে কে কোন উচ্চতার মানুষ, তা তারা দেখে, অনুভব করে ও স্পর্শ করে বুঝতে পারে। তবে নারীদের ধারে কাছে কেউ ঘেষতে চায় না। তারা সাংঘাতিক (এটা লেখক বিদ্রুপাত্মক অর্থে, অর্থাৎ সেই সমাজের রীতিকে বিদ্রুপ করে দেখিয়েছেন)। এদের কোণের মান অত্যন্ত কম হওয়ায় মাথা থাকে সূচালো। যে কোনো সময় আঘাত করে বসতে পারে সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষকে। কর্মী, পুলিশ বা খানসামাদের অবস্থাও প্রায় একইরকম। কেউ যাতে ছদ্মবেশ ধরে বৃত্তের মতো কন্ঠস্বর পরিবর্তন করে কাউকে বোকা বানাতে না পারে, সে জন্য আছে শাস্তির ব্যবস্থা। অর্থাৎ পুরোপুরি একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই বিশ্বে। সেখানকার অধিবাসীরা সব জ্যামিতিক আকৃতি। 

চাইলেই ত্রিমাত্রিক বিশ্ব থেকে এসে দ্বিমাত্রিক বিশ্বের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। প্রতিবার দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এক হাজার বছর। গোলক এসেছে একটি মিশন নিয়ে। কী সেই মিশন?

বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে গণিতবিদ স্বপ্নে একটি অন্য বিশ্বের সন্ধান পায়। একমাত্রার বিশ্ব। সেখানে সবকিছু শুধু সরলরেখা আর বিন্দু। শুধু দৈর্ঘ্য আছে সে বিশ্বে। সেই একমাত্রার বিশ্বের রাজার সঙ্গে পরিচিত হয় গণিতবিদ বর্গ। জানতে পারে অনেক নতুন তথ্য। যেমন সেখানে সবাই বিয়ে করলেও কাছাকাছি একসঙ্গে থাকে না। তবু তাদের বাচ্চা হয়। প্রত্যেক পুরুষের দুটি বিয়ে করা বাধ্যতামূলক। আবার তাদের একসঙ্গে সবসময় তিনটি বাচ্চা হয়। দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। একটি বা দুটি সন্তান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেন শুধু তিনটি সন্তান হয়, সব পুরুষের কেন দুটি বিয়ে বাধ্যতামূলক, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইয়ে। 

গণিতবিদের এরপর পরিচয় হয় ত্রিমাত্রিক বিশ্বের এক গোলকের সঙ্গে। এটা অবশ্য স্বপ্নে নয়, বাস্তবে। গোলক ত্রিমাত্রিক বিশ্ব থেকে দেখা করতে আসে দ্বিমাত্রিক বিশ্বের এই গণিতবিদের সঙ্গে। চাইলেই ত্রিমাত্রিক বিশ্ব থেকে এসে দ্বিমাত্রিক বিশ্বের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। প্রতিবার দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এক হাজার বছর। গোলক এসেছে একটি মিশন নিয়ে। কী সেই মিশন? বর্গের এখানে কাজ কী?

এসব প্রশ্নের উত্তর পাবেন বইটি পড়লে। কেন বর্গ অভাগা, তা জানতে পারবেন বিস্তারিত। কেউ কেউ হয়তো বর্গের সঙ্গে মিল পাবেন আদিকালের গ্যালেলিও কিংবা কোপার্নিকাসের সঙ্গে।

বইটি পড়ে পাঠক ভিন্ন রকমের মজা পাবেন, তা বলা যায়। শুরুর পর্ব একটু একঘেয়ে লাগতে পারে। কারণ সেখানে তেমন গল্প নেই। শুধু পরিচিতি পর্ব। তবে দ্বিতীয় পর্বে গল্পের শুরু হলে আসল মজাও শুরু হবে। বিশেষ করে যখন গোলক বর্গকে বোঝাতে চায়, সে ত্রিমাত্রিক বিশ্ব থেকে এসেছে। আপনাকে কেউ যদি এসে বলে, আমি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছি, বিশ্বাস করবেন? নিশ্চয়ই কথা কাটাকাটি করবেন, অবিশ্বাস করবেন। আর আপনাকে যদি সেই এলিয়েনের প্রয়োজন থাকে, তাহলে বোঝানোর নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে নানা ধরনের প্রমাণ দেখানোর চেষ্টা করবে। এখানেও আছে সে কাহিনি। তাই আশা করি বইটি পড়ে কেউ হতাশ হবেন না। 

একনজরে

ফ্ল্যাটল্যান্ড: বহুমাত্রিক জগতের খোঁজে

লেখক: এডুইন এ অ্যাবট

অনুবাদক: উচ্ছ্বাস তৌসিফ

প্রকাশক: আফসার ব্রাদার্স

প্রচ্ছদ: আবরার আবীর

মূল্য: ২৭৫ টাকা

পৃষ্ঠা: ১৩৬

বইয়ের অসংগতি কিংবা বানান ভুল চোখে পড়েনি। তবে বাঁধাই বা কাগজের মান মোটামুটি। 

এটি সায়েন্স ফিকশন হলেও একটু অন্য ঘরানার। মানুষের পরিবর্তে শুধু জ্যামিতিক আকার নিয়ে কাহিনি। তাই একটু মনযোগী না হলে একঘেয়ে লাগতে পারে। চরিত্রদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগবে। তবে সুবিধার কথা হলো, বইয়ে প্রচুর টীকা ব্যবহৃত হয়েছে। তাই গাণিতিক কল্পগল্প হলেও বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না। পাশাপাশি বইয়ে বেশ কিছু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোও বাংলায়। অর্থাৎ গল্পের পুরোপুরি যাতে বুঝতে পারেন, সেরকম সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে। 

বইয়ের অসংগতি কিংবা বানান ভুল চোখে পড়েনি। তবে কাগজের মান বা বাঁধাই নিয়ে কিছুটা আফসোস হতে পারে। এবারের বই মেলায় বেশ কিছু প্রকাশনী বাঁধাইয়ে এর চেয়ে ভালো করেছে, কাগজ ভালো দিয়েছে। সেগুলোর কোনোটা আপনি সংগ্রহ করলে এই আফসোস হতেই পারে। অর্থাৎ বাঁধাই বা কাগজের মান মোটামুটি মানের। 

বইটি অনুবাদ করেছেন উছ্বাস তৌসিফ। সুঅনুবাদক হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি পরিচিত। এর আগে অ্যান্টিম্যাটার, সিক্স ইজি পিসেস ও রসায়ন: সহজ পাঠ অনুবাদ করে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। এই বইয়েও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। বইটির গাণিতিক ভাষা কঠিন হলেও তিনি নিজের মতো করে তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় বন্ধনী ব্যবহার করে নিজের যুক্তি প্রকাশ করেছেন। 

বইটি দেশের বিভিন্ন অফলাইন ও অনলাইন বুকশপে পাওয়া যাচ্ছে।