বিজ্ঞানচিন্তার চলতি সংখ্যা পাঠের বিস্ময়

বিজ্ঞানচিন্তার আমি সবিশেষ আগ্রহী পাঠক। প্রথম সংখ্যা থেকে এ যাবৎ প্রকাশিত কিশোর-তরুণ পাঠকদের উপযোগী এই সাময়িকীটির কোনো সংখ্যারই পাঠ থেকে নিজেকে আমি বঞ্চিত করিনি। নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও এই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়েই আমি প্রবল আগ্রহী। এক সময় ইংরেজি নিউ সায়েন্টিস্ট সাময়িকীর আগ্রহী পাঠক ছিলাম। এখন ছাপা নয়, যতদূর সম্ভব সেটি পাঠ করার চেষ্টা করি অনলাইনে।

বিজ্ঞানচিন্তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রতি সংখ্যায় চমকে দেওয়ার মতো বিষয় নির্বাচন করা ও পাতায় পাতায় তা তুলে ধরা। যেমন এই সংখ্যার বিষয় ‘সৌরজগতের বিস্ময়’।

আহসান হাবীবের ‘ভুলোমন বিজ্ঞানী’, শেখ সালাহ্‌উদ্দীনের কবিতা ‘এআই’ পড়ে মন আনন্দিত হলেও, বিস্ময়ের পর বিস্ময় মনকে আন্দোলিত করে প্রদীপ দেবের ‘বিস্ময়ভরা সৌরজগৎ’ শিরোনামের মলাট কাহিনিটি। এরপর ‘গ্রহে গ্রহে বেড়াই ঘুরে’ এবং ‘সূর্য ও তার সন্তানেরা’ অংশের সচিত্র তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধগুলো কত অজানাকে জানিয়ে যায়, নিয়ে যায় চিন্তার অনিঃশেষ জগতে, তা বলে শেষ করা যাবে না। সেই সঙ্গে বিমান নাথের ‘নবম গ্রহের রহস্য’ শুধু কিশোর পাঠক নয়, বয়স্ক পাঠককেও নিবন্ধটি পাঠে আগ্রহী করে তুলবে। এই নিবন্ধটির পর পরই আবারও এসেছে কিছু সচিত্র নিবন্ধ—‘গ্রহাণুবেষ্টনী: গ্রহাণুদের আবাসস্থল’, ‘ওর্ট মেঘ: সৌরজগতের শেষ সীমা’ ইত্যাদি।

এরপর ‘গ্রহে গ্রহে বেড়াই ঘুরে’ এবং ‘সূর্য ও তার সন্তানেরা’ অংশের সচিত্র তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধগুলো কত অজানাকে জানিয়ে যায়, নিয়ে যায় চিন্তার অনিঃশেষ জগতে, তা বলে শেষ করা যাবে না

এর পরেই আছে নিয়মিত আয়োজন—দুই পাতার বিজ্ঞান কমিক। শিরোনাম—‘দাঁতে পোকা ধরে কেন’। আব্দুল কাইয়ুমের লেখা ও অনিন্দ্য মুন্তাসিরের সচিত্রকরণে কমিকটি সংক্ষিপ্ত হলেও পড়ে বেশ মজা পেয়েছি। বিজ্ঞানের এমন একটি বিষয় নিয়েও যে কার্টুন হতে পারে, বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা সেটা তুলে ধরেছেন। আমরা বিজ্ঞানবিষয়ক এমন কার্টুন আরও বেশি করে চাই। এই কাজটি চালিয়ে যেতে হবে কিশোর-তরুণ পাঠকদের কথা মনে রেখে।

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক আরশাদ মোমেনের এই সংখ্যায় নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাত্কারটি সবিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। তাঁর সাক্ষাত্কারের শিরোনাম ‘জগৎটাকে গাণিতিকভাবে দেখা শুরু করা উচিত’। এই সাক্ষাত্কারে অধ্যাপক আরশাদ মোমেন সার্বিক যে বক্তব্য রেখেছেন এবং শেষ পর্যন্ত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে সিদ্ধান্ত তুলে ধরেছেন, তা আমাদের চিন্তার সঙ্গী হয়ে ওঠে, মনকে আলোকিত না করে পারে না।

বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল ২০২৪ সংখ্যার প্রচ্ছদ

‘জীবনের নীলনকশার খোঁজে’ শিরোনামের ছোট্ট নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে জগত্খ্যাত তিন বিজ্ঞানীর পরিচিতি। তাঁরা হলেন ফ্রান্সিক ক্রিক, জেমস ওয়াটসন এবং রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। বলা হয়েছে, ‘এই তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের কারণেই আমরা জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছি। আমরা এখন জানি, কীভাবে ডিএনএ সব প্রোটিনের জন্য নির্দেশনা বহন করে।’ এই কোড পড়তে পারার কারণে আমরা বিজ্ঞানকে নতুনভাবে ব্যবহার করতে পারছি। যেমন অপরাধীদের ধরতে, ভাইরাস কাবু করতে কিংবা ওষুধের সাহায্যে জীবন বাঁচাতে।’ বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদনা দলের সদস্য কাজী আকাশের লেখা এই নিবন্ধটি অতি সংক্ষিপ্ত হলেও তিন বিজ্ঞানীর পরিচিতি তুলে ধরে তিনি যে তথ্য হাজির করেছেন, তা সত্যি অমূল্য।

‘বিজ্ঞানের চোখে সবাই সমান’ নিবন্ধটির লেখক বিজ্ঞানবক্তা আসিফ। নিবন্ধটি সংক্ষিপ্ত হলেও খুব কৌতূহলোদ্দীপক। বিশেষ করে তিনি যখন তাঁর নিবন্ধের শেষে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ‘২২১ জন নাবিকের জীবনের বিনিময়ে বোঝা গেল পৃথিবী গোল, পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বসবাস। প্রকৃতিতে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই।’—তখন নিশ্চিতই লেখকের বক্তব্য আমাদের মন আলোড়িত করে।

বিশ্ব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানকে যে কোনোভাবেই তুচ্ছ করার অবকাশ নেই, প্রফেসর সেলিম টি এস আল-হাসসানি তাঁর ১০০১ ইনভেনশনস: এনডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন গ্রন্থের মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন। বাংলায় অনুবাদ গ্রন্থটির ভাষান্তর করেছেন মিরাজ রহমান ও মো. আবুল বাশার। ‘বিজ্ঞানাকাশে আরব তারাদের কথা’ শিরোনামে বইটির সংক্ষিপ্ত পরিচিত তুলে ধরেছেন মুনিয়া মানতাসা। খুবই সুখপাঠ্য।

এ নিবন্ধে তিনি তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দেওয়ার সেই কাহিনি, যা বিশ্বের বিজ্ঞানী সমাজে তোলে তুমুল আলোড়ন। বদলে দেয় প্রচলিত বিজ্ঞানের ধারণাও

বিজ্ঞান-লেখক ও বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার লিখেছেন ‘আলোর বুলেট এবং আইনস্টাইন’। এ নিবন্ধে তিনি তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দেওয়ার সেই কাহিনি, যা বিশ্বের বিজ্ঞানী সমাজে তোলে তুমুল আলোড়ন। বদলে দেয় প্রচলিত বিজ্ঞানের ধারণাও।

ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লেগেছে ‘প্রজাপতির কি শুঁয়াপোকা অবস্থার কথা মনে থাকে’। ছোট্ট এক পাতার লেখাটি। সব বয়সী পাঠকেরই ভালো লাগবে।

এরপর দুটি বিজ্ঞান কল্পগল্পের কথা না বললেই নয়। ‘দ্য ওয়েপন’ গল্পটি অনুবাদ করেছেন হাসান খুরশীদ রুমী। মূল লেখক ফ্রেডরিক ব্রাউন। ঝরঝরে অনুবাদ। গল্পের বিষয়বস্তুও মনোহারী। উচ্ছ্বাস তৌসিফ, লেখক ও বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক লিখেছেন ‘পেশেন্ট জিরো’। বিজ্ঞান কল্পগল্পের ক্ষেত্রে এ গল্পের বিষয়বস্তু আমার কাছে খুবই নতুন মনে হয়েছে। আমার একান্ত কামনা, উচ্ছ্বাস তৌসিফ তাঁর এই গল্প লেখার প্রয়াস অব্যাহত রাখবেন।

‘নতুন জানলাম’ বিভাগটি আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে। এই বিভাগটি সামনের প্রতিটি সংখ্যাতেই রাখার আবেদন জানাচ্ছি সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত সবার কাছে। ‘মাইক্রোস্কোপের নিচে কান’, ‘চেনা-অচেনা চিকেনপক্স’, ‘কার্যকারণ’, ‘পাঠকের প্রশ্ন ও উত্তর’, গণিতের কুইজ ও অন্যান্য কুইজের  আয়োজন নিশ্চিতই পাঠক মনে চিন্তা উসকে দেবে।

বস্তুত বিজ্ঞানচিন্তা আমাদের কিশোর ও তরুণসমাজের জন্য স্থায়ী সম্পদ হয়ে উঠেছে। চলতি সংখ্যার বিষয়বস্তু এই স্থায়িত্ব আরও দৃঢ় করবে নিঃসন্দেহে।