কোয়ান্টাম কম্পিউটিং

কম্পিউটার প্রযুক্তি এত শক্তিশালী হয়েছে যে মানুষের হাতঘড়িতে শক্তিশালী কম্পিউটার ও সেন্সর কাজ করছে। কিন্তু কম্পিউটারবিজ্ঞানীরা এই অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট না থেকে বরং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও শক্তিশালী কম্পিউটার তৈরি করার এক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁদের সামনে শুধু একটি সমস্যা, কম্পিউটার চিপের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চিপের আকৃতি ক্ষুদ্র হতে চলেছে। খুব এটা শীঘ্রই সাব-অ্যাটোমিক বা পারমাণবিক কণার পর্যায়ে চলে যাবে। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা থেকে আমরা জানতে পারি, ক্ষুদ্র কণাদের জগতে অনেক অদ্ভুত সব নিয়ম রয়েছে, যা আমাদের পরিচিত জগতে অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়। কম্পিউটার যখন কোয়ান্টাম জগতে প্রবেশ করবে, তার মধ্যেও এই অদ্ভুত নিয়মগুলো কাজ করতে থাকবে। যার ফলে সেই কম্পিউটারের মধ্যে বিস্ময়কর কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা দেবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের পরিচিত যেকোনো কম্পিউটার, এমনকি সুপারকম্পিউটার থেকেও বহুগুণে এগিয়ে থাকবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখনো তার সূচনালগ্ন পার করছে। ফলে আমাদের মোবাইলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসতে এখনো অনেক দেরি। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগাতে পারলে বিজ্ঞান ও গবেষণায় এক নতুন জোয়ার দেখা যাবে। অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ব্যাটারি তৈরি করা যাবে, রসায়নে নতুন নতুন আবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখা দেবে, যার ফলে স্বল্প ব্যয়ে অধিক উৎপাদন সম্ভব হবে, অত্যাধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।

সব ধরনের কাজে কিন্তু সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজের গতি বেশি হবে না। তবে বেশি জটিল সমস্যার সমাধান বের করতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জুড়ি নেই। সমস্যা যত জটিল হবে, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের তুলনায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কার্যদক্ষতা তত বাড়বে। কিছু কিছু সমস্যার সমাধান বের করা সাধারণ কম্পিউটারের কাছে প্রায় অসম্ভব। এ ধরনের সমস্যার সমাধানও কোয়ান্টাম কম্পিউটার অবিশ্বাস্য দ্রুততায় করে ফেলতে পারে।

একটি ছোট্ট উদাহরণ দেখা যাক। ধরা যাক, আমাদের সামনে একটি ফোনবুক রয়েছে এবং এই ফোনবুকে ১৬ কোটি মানুষের নাম ও ফোন নম্বর রয়েছে। সাধারণ কম্পিউটারের মাধ্যমে যদি আমরা এই ফোনবুকে কারও নাম সার্চ করে বের করতে চাই, তাহলে তাকে গড়ে ৮ কোটি অপারেশন সম্পন্ন করতে হবে। যত বেশি অপারেশন বা কাজ করার প্রয়োজন হবে, তত বেশি সময় এবং এনার্জি প্রয়োজন হবে। অথচ এই একই কাজ একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার করে অন্যভাবে। এই কম্পিউটার গ্রোভারস অ্যালগরিদম ব্যবহার করে এ কাজে। এই অ্যালগরিদম মাত্র ১৬ হাজার অপারেশন চালিয়ে ফলাফল বের করতে পারবে!

কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার প্রক্রিয়া যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। তবে এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করছেন প্রযুক্তিবিদেরা। কারণ গুগল, আইবিএম ও মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টরা বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং মেধা ব্যয় করছে এর পেছনে। সিবি ইনসাইটের মতে, ২০১৭ সালে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের পেছনে এর আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। শুধু ২০১৭ সালেই এই খাতে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ২৪১ মিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে সিলিকন ভ্যালিসহ বিশ্বজুড়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার নির্মাণের জন্য গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্টার্টআপ।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার প্রতিযোগিতায় রয়েছে গুগল, আইবিএম, মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টরা।

ঠিক কোন কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এত শক্তিশালী, তা বুঝতে ০হলে আমাদের কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকতে হবে। সহজ ভাষায়, অতি ক্ষুদ্র কণা বা সাব অ্যাটমিক পার্টিকেল আমাদের পরিচিত জগতের মতো আচরণ করে না। ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র কণাকে ‌‘কণা’ বলি ঠিকই, একই সঙ্গে এরা তরঙ্গের মতো আচরণ করে। মাত্র কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে এই ক্ষুদ্র কণারা অনেক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন এই কণাদের পর্যবেক্ষণ না করা হলে তাদের বিভিন্ন বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, যেমন অবস্থান বাস্তবে থাকে না। অর্থাৎ একটি ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ করার পরই সেই ইলেকট্রনের কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান থাকবে।

অতিক্ষুদ্র কণাদের এমন বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বুঝতে গিয়ে বড় বড় বিজ্ঞানীদেরও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় অবদানের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, যাঁকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জনক বলা হয়, সেই রিচার্ড ফাইনম্যানও ১৯৬৪ সালে এমআইটির এক লেকচারে অকপটে স্বীকার করেছেন, কেউই কোয়ান্টাম মেকানিকস বুঝতে পারেন না।

মুরস ল থেকে আমরা জানতে পারি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার চিপের আকার ছোট হতে থাকবে। বিজ্ঞানীরা গত শতাব্দীর শেষের দিকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, শিগগিরই কম্পিউটার চিপ একটি ক্ষুদ্র কণার মতোই ছোট হয়ে যাবে। ফলে সেই কম্পিউটার চিপে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে আইন।

আমাদের পরিচিত কম্পিউটার, সুপারকম্পিউটার ও মোবাইল মূলত বাইনারি সিস্টেমে ক্যালকুলেশন করে। তারা প্রাপ্ত তথ্যকে ডিজিটাল বিটের (০ এবং ১) সিরিজে রূপান্তরিত করে এদের ওপর বিভিন্ন অপারেশন সম্পন্ন করে। একটি কম্পিউটার কোনো সার্কিটের ভোল্টেজ অফ বা অন করার মাধ্যমে সাধারণত ০ এবং ১ নির্ধারণ করে। একটি সার্কিটের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন অথবা অফ যেকোনো একটি থাকা সম্ভব। ফলে একটি কম্পিউটারে যত বেশি সার্কিট থাকে, সেই কম্পিউটারের কার্যক্ষমতা সাধারণত তত বেশি হয়।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারও বিশেষ ধরনের বিট ব্যবহার করে ক্যালকুলেশন করা হয়। এই বিশেষ ধরনের বিটকে বলা হয় কিউবিট। কিউবিট তৈরি করার একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। কিছু পরিচিত পদ্ধতি হলো সুপারকনডাক্টিং সার্কিট ব্যবহার করা অথবা বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে শূন্যে ভেসে থাকা ক্ষুদ্র কণা বা অ্যাটম ব্যবহার করা।

কিউবিট এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার ক্ষেত্রে এ ধরনের বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করার বিশেষ একটি কারণ আছে। সেটা হলো কোয়ান্টাম ডিকোহেরেন্স নামের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাহ্যিক পরিবেশের সংস্পর্শে এলে কিউবিট তার অদ্ভুতুড়ে গুণাবলি হারিয়ে ফেলতে থাকে। ফলে এর কার্যক্ষমতাও কমে যায়। কিউবিটের সব গুণাবলি বজায় রাখার জন্য বিজ্ঞানীরা এ রকম অনেকগুলো কৌশল ব্যবহার করেছেন।

এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার কেন এত দ্রুত সমাধান বের করতে পারে? সাধারণ কম্পিউটারের বিট একসময় ০ অথবা ১, যেকোনো একটি মান রাখতে পারে। ফলে কোনো সমস্যার সমাধান বের করার জন্য সম্ভাব্য সব সমাধান এক এক করে পরীক্ষা করে দেখতে হয় কম্পিউটারকে। এই প্রক্রিয়ায় সমস্যা যত জটিল হতে থাকবে, সমাধান বের করতে তত বেশি সময় লাগবে।

সাধারণত এভাবে কম্পিউটার ধাপে ধাপে সমাধান বের করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিট তার সুপারপজিশন এবং অ্যান্ট্যাঙ্গলমেন্টের মতো বিশেষ গুণাবলি ব্যবহার করে। একই সঙ্গে একাধিক সম্ভাব্য সমাধান পরীক্ষা করে দেখতে পারে। একই সঙ্গে একাধিক পথ বা সমাধান পরীক্ষা করে দেখার এই ক্ষমতার কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দ্রুত সমাধানে আসতে পারে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে কম্পিউটিংয়ের নতুন এক যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। এর সাহায্যে উন্নত মহাকাশযান থেকে শুরু করে খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞান বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ঢাকা