মনের গহনের অজানা কথা

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ। পাভলভ রোডের এক গলিতে ঘুরে বেড়ায় অজস্র কুকর। যেন-তেন কুকুর নয়, একেবারে প্রশিক্ষিত কুকুর যাকে বলে। সামনে এগোলেই একটা ল্যাবরেটরি। নানা রকম যন্ত্রে ভরা। আর রাজ্যের কুকুরের ভিড়। হঠাত্ দেখবেন কুকুরগুলো গায়েব হয়ে গেছে। ভড়কাবার কিছু নেই। ভূতের কারবারির বাস নয় সেই ল্যাবরেটরিতে। সেখানেই গবেষণা করেন একদল গবেষক। মানুষের মন নিয়ে তাদের কারবার।

কিন্তু কুকুরের মনের সঙ্গে মানুষের মনের যোগ কোথায়? আর এর সাথে কুকুরগুলো গায়েব হওয়ারই বা কী সম্পর্ক? সেটা জানতে হলে পড়তে হবে শোনো বলি মনের কথা বইটি।

শোনো বলি মনের কথা ।। লেখক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।। প্রকাশক: অনুসন্ধিত্সু চক্র।। প্রথম অনুসন্ধিত্সু প্রকাশ: জুন ২০০৬।। পৃষ্ঠা: ৪২ ।। দাম: ৫০ টাকা

পাভলভের প্রথম কাজ ছিল মস্তিষ্কের উদ্দীপক আর নিঃসরক নিয়ে। কোন পরিস্থিতিতে হরমোন কোষগুলো সাড়া দেয়, আর কোন পরিস্থিতিতে সেখান থেকে হরমোনের নিঃসরণ ঘটে, তার নিখুঁত হিসাব বের করেছিলেন পাভলভ আর তাঁর উত্তরসূরিরা। সেটা থেকেই পরে মানব মনের গতি-প্রকৃতি, মানসিক রোগগুলোর কারণ আর তার প্রতিকার সম্ভব হয়। এ জন্য পাভলভ দাঁড় করিয়েছিলেন রিফ্লেক্স অ্যাকশন বা প্রতিবর্তী ক্রিয়া তত্ত্ব। একটা কুকুরের মুখ থেকে কখন বেশি লালা ঝরে, কোন খাবার দিলে খুব বেশি পরিমাণ লালা এসে জমা হয় কুকুরে মুখের ভেতর, কোন খাবারে লালা একেবারেই আসে না, আর লালার সঙ্গে কুকুরের মস্তিষ্কের সম্পর্কটা কেমন, তা দেখিয়েছিলেন পাভলভ হাতে-কলমে।

লেখক এ বইয়ে উন্মোচন করেছেন সেই লালা রহস্যের সমাধান। শুনিয়েছেন বোলতা আর মাকড়সার সংবাদ। কেন বোলতা মাকড়সা শিকার করে, কেনই বা সেটা ধরে নিয়ে গিয়ে তার ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ধরা পড়া একটা মাকড়সা কোনোভাবে হাতছাড়া হয়ে গেলে কেন বোলতার আরেকটা ঘর বানায়, এমন পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ কী করত, তাঁর একটা তুলনামুলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক গল্পের ঢংয়ে। কুকর, বোলতা, জীবজন্তুর জগত্ থেকে লেখক চলে গেছেন অ্যামিবার সঙ্গে মানুষের তুলনায়। তারপর মানব মনের গভীরে ঢুকে এর ক্রিয়াকলাপ তুলে ধরেছেন একেবারে গল্পের ছলে। আসলে কুকুরদের নিয়ে মনের গবেষণাটা প্রথম শুরু করেন রুশ বিজ্ঞানী ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ। সেকালে মানুষ নিয়ে গবেষণাটা অত সহজ ছিল না। তা ছাড়া দিনের পর দিন কাজকর্ম বাদ দিয়ে ল্যাবরেটরিতে বসে বিজ্ঞানীর গিনিপিগ হওয়ার লোক এ যুগেও মেলে না। পাভলভ তাই শুরুটা করেন ককুরদের নিয়েই। এটা মানুষ আর কুকুরের ব্যাপর নয়। কিছু বৈশিষ্ট্য সব প্রাণীরই আছে। তা ছাড়া অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণির প্রাণীদের নিয়ে ধাপে ধাপে কাজ করলে গবেষণাটা গড়ে ওঠে ধীরে সুস্থে, সুন্দরভাবে।

বিজ্ঞান উঠে এসেছে গল্পের ঢংয়ে, সেটা দেবীপ্রসাদের বিজ্ঞানলেখনীর সহজাত বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানকে তিনি কখনো জটিল ভাষায় বর্ণনা করেননি। তাই ছয় দশক পেরিয়ে এসেও তাঁর বিজ্ঞানমুখী বইগুলো বাংলাভাষাভাষীদের কাছে সমান জনপ্রিয়। বিজ্ঞান কি ও কেন, মানুষ কী করে বড়ো হলো, ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব’র মতো দেবীপ্রসাদের অন্যতম একটা মাস্টারপিস হলো এই শোনো বলি মনের কথা। বইটি প্রথম প্রকাশ করা হয় ১৯৪০-এর দশকে। যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেছে। তবু বাংলার কিশোর-তরুণদের কাছে এই বইয়ের আবেদন কমেনি এতটুকুও। তাই অগণিত বিজ্ঞানপিপাসু পাঠকদের কথা ভেবে সুলভে বইটির পুনর্মুদ্রণ করে অসিন্ধিত্সু চক্র। বইটা পাওয়া যাচ্ছে দেশের সব অভিজাত বইয়ের দোকানে।