কিছু মৌল তেজস্ক্রিয় হয় কেন

আমাদের চেনা পরিচিত সব বস্তু বা পদার্থ তৈরি হয়েছে পরমাণু দিয়ে। আর প্রতিটি পরমাণুতে থাকে কিছু অতিপারমাণবিক কণা। সেগুলো হলো প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন কণা। প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক, নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ এবং ইলেকট্রন ঋণাত্মক। প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত হয় পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ বা নিউক্লিয়াস। এই দুই কণাকে একত্রে আটকে রাখে শক্তিশালী পরমাণবিক বল। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে সমসংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রন থাকলে, এই পারমাণবিক শক্তিতেও ভারসাম্য থাকে।

নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। সাধারণত একটি প্রোটনের ধনাত্মক চার্জকে ভারসাম্যে আনতে একটি ইলেকট্রনের প্রয়োজন হয়। এভাবেই গোটা পরমাণুতে বৈদ্যুতিক চার্জে ভারসাম্য আসে। আমাদের চেনাজানা বেশির ভাগ পরমাণু এভাবে নিজেদের ভারসাম্য বজায় রাখে।

প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত হয় পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ বা নিউক্লিয়াস। এই দুই কণাকে একত্রে আটকে রাখে শক্তিশালী পরমাণবিক বল।

হাইড্রোজেন পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা একটি, ইলেকট্রনের সংখ্যাও একটি। সাধারণ হাইড্রোজেনে কোনো নিউট্রন থাকে না। হিলিয়াম পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা দুটি, নিউট্রন ও ইলেকট্রন থাকে দুটি করে। পরমাণু যত ভারী হতে থাকে, ততই তার প্রোটন সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে তার নিউট্রন এবং ইলেকট্রন সংখ্যাও। এভাবে পরমাণুর অতিপারমাণবিক কণাগুলোর সংখ্যার সমতার মাধ্যমে কোনো মৌল ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু এই ভারসাম্য না থাকলে কী ঘটতে পারে?

পরমাণু বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ নিঃসরণ করে। যেমন আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি বিকিরণ। এটাই পরমাণুর তেজস্ক্রিয়তা
প্রাকৃতিকভাবে গঠিত সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়ামের কথা বলা যাক। প্রকৃতিতে দুই ধরনের ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং ইউরেনিয়াম-২৩৮। এদের বলা হয় আইসোটোপ।

কোনো পরমাণুতে প্রোটন বা নিউট্রনের সংখ্যা সমান না হলে সাধারণত নিউক্লিয়াসের পারমাণবিক বলের মধ্যে ভারসাম্য থাকে না। অর্থাৎ পরমাণুটি অস্থিতিশীল। তখন সেটা উত্তেজিত অবস্থায় থাকে। কিন্তু পরমাণু এরকম অস্থিতিশীল অবস্থায় টিকে থাকতে পারে না। ফলে নিউক্লিয়াস থেকে অতিরিক্ত শক্তি বের করে দিয়ে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আসতে চায়। ফলে পরমাণু বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ নিঃসরণ করে। যেমন আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি বিকিরণ। এটাই পরমাণুর তেজস্ক্রিয়তা। এভাবে একটি ভারী পরমাণু ভেঙে ছোট ছোট দুটি পরমাণুতেও পরিণত হতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় ক্ষয়।

যেমন প্রাকৃতিকভাবে গঠিত সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়ামের কথা বলা যাক। প্রকৃতিতে দুই ধরনের ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং ইউরেনিয়াম-২৩৮। এদের বলা হয় আইসোটোপ। এদের দুটিতেই প্রোটনের সংখ্যা সমান, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা আলাদা। ইউরেনিয়াম-২৩৫-এ প্রোটনের সংখ্যা ৯২টি, ইলেকট্রনের সংখ্যা ৯২টি, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা ১৪৩টি। সে কারণেই এর নাম ইউরেনিয়াম-২৩৫ (৯২+১৪৩ = ২৩৫)। অন্যদিকে ইউরেনিয়াম-২৩৮-এ প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা আগের মতো হলেও নিউট্রনের সংখ্যা থাকে ১৪৬টি। বুঝতেই পারছেন, ইউরেনিয়াম-২৩৫ পরমাণু অস্থিতিশীল। কারণ এর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের চেয়ে নিউট্রন কণা বেশি। ফলে এই পরমাণু একটি স্থিতিশীল অবস্থায় যেতে চায়। সেটি করতে গিয়ে পরমাণুটি ক্রমাগত বিকিরণ নিঃসরণ করে। এভাবে পরমাণুটি ভাঙতে ভাঙতে সীসায় পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, সীসা স্থিতিশীল মৌল। ইউরেনিয়াম-২৩৮-ও ভাঙতে ভাঙতে সীসায় এসে স্থির হয়।

মহাবিশ্বের সবকিছুর মধ্যেই আসলে অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে স্থিতিশীল অবস্থায় আসার প্রবণতা দেখা যায়। তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলোও সে কথা বলে। এভাবেই মহাবিশ্বে ভারসাম্য বজায় থাকে।