রেডিও শব্দটি যেভাবে পেলাম

নতুন কিছু আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এসব নামের পেছনেও লুকিয়ে থাকে মজার ইতিহাস

রেডিও শব্দটি এখন বেতারযন্ত্রের জন্যই বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইংরেজি এই রেডিও শব্দের উত্পত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ রেডিয়াস (Radius) থেকে, যার মূল অর্থ চাকার স্পোক বা আলোর রশ্মি বিকিরণ রেখা। অর্থাৎ রশ্মির সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হতো। আবার এই শব্দ থেকেই বৃত্তের রেডিয়াস বা ব্যাসার্ধ শব্দটির উত্পত্তি। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ১৮৮১ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মারকাডিয়ারের পরামর্শে প্রথম রেডিওফোন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন টেলিফোনের উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল। ‘বিচ্ছুরিত শব্দ’ বোঝাতে রেডিওফোন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল সেবার।

১৮৬৫ সালে বিদ্যুৎচুম্বকবিষয়ক ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছিল। এতে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বেগ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের এই ভবিষ্যদ্বাণী ১৮৭৯ সালে প্রমাণ করেছিলেন হেনরিক হার্জ। এরপর বিদ্যুৎচুম্বকীয় এই বিকিরণকে ডাকা হতে লাগল হার্জেয়ান তরঙ্গ। আর এই তরঙ্গ ব্যবহার করে যোগাযোগ করাকে বলা হতো ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি। এর এক দশক পর রেডিও শব্দটিকে সংযোজক অব্যয় হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি পদার্থবিদ এডুয়ার্ড ব্রানলি। রেডিও সংকেত শনাক্ত করতে একটি যন্ত্র বানিয়েছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন রেডিও-কন্ডাক্টর। এর পরপরই ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ বা রেডিওটেলিগ্রাফ ও রেডিওটেলিগ্রাফি (রেডিয়েশনের মাধ্যমে টেলিগ্রাফি) শব্দগুলো ইউরোপে ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে শব্দটিকে ছোট করে শুধু ওয়্যারলেস বা রেডিও নামে ডাকা হতে লাগল। তবে ইউরোপে রেডিওর পরিবর্তে ওয়্যারলেস শব্দটিই বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। ইউরোপে ১৮৯০ দশকের মাঝামাঝি ব্যবহারযোগ্য রেডিও প্রেরক ও গ্রাহকযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। এতে হার্জেয়ান তরঙ্গ (আসলে রেডিও তরঙ্গ) ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই থেকে হার্জেয়ান তরঙ্গকে বলা হতে লাগল রেডিও ওয়েব বা রেডিও তরঙ্গ (বাংলায় বেতারতরঙ্গ)। বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বর্ণালিরেখায় সর্বোচ্চ ৩০০ গিগাহার্জ থেকে ৩০ হার্জ পর্যন্ত কম্পাঙ্কবিশিষ্ট তরঙ্গকে বলা হয় রেডিও তরঙ্গ। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েক সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে কয়েক মিটার বা কয়েক কিলোমিটার লম্বা হতে পারে।

২০ শতকের একেবারের শুরুর দিকে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে কথা পাঠানো এবং তা গ্রহণের ক্ষেত্রে সামান্য সফলতা পাওয়া গিয়েছিল। তখনো একে ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি বা তারবিহীন দূরবার্তা নামেই ডাকা হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সীমিত পরিসরে সামরিক যোগাযোগে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করা শুরু হয়। এ সময় গ্রাহকযন্ত্রের জন্য রেডিও রিসিভার শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের পরে বাণিজ্যিকভাবে রেডিও সম্প্রচার শুরু হয়। এ সময় অনেকেই রেডিও রিসিভারের নামের আজব এক যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়। তবে ১৯২১ সালের পত্রপত্রিকায়ও রেডিওকে ওয়্যারলেস টেলিফোনি নামে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই শব্দই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বেশ চালু ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীতে রেডিও শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই থেকেই পত্রপত্রিকা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে রেডিও শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্রমেই রেডিও রিসিভার ছোট হয়ে যন্ত্রটির নাম রেডিও হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষায় রেডিও রিসিভার যন্ত্রটির জন্য বেতার শব্দটিই বেশি জনপ্রিয়। আর এ শব্দ ওয়্যারলেস টেলিফোনি থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।