অ্যান্টিবায়োটিকে ভাইরাস নির্মূল করা যায় না কেন?

ভাইরাস হলো দেহকোষের ডিএনএ অথবা আরএনএর জেনেটিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত খুব ক্ষুদ্র কণা। এর চারপাশে থাকে প্রোটিনের আবরণ। কোনো কোনো ভাইরাসে এই আবরণের চারপাশে স্পাইক প্রোটিনও থাকে। জীবকোষের বাইরে ভাইরাস নির্জীব, মৃত। নিজে তার প্রতিলিপি তৈরি বা বংশবিস্তার করতে পারে না। বংশবিস্তারের জন্য প্রাণিদেহের জীবকোষের বংশবিস্তারের নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করার দরকার হয়। এ জন্য ভাইরাস সাধারণত কোনো প্রাণিদেহে ঢুকে তার বহিরাবরণের কোনো প্রোটিনের (করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সেটা স্পাইক প্রোটিন) সাহায্যে জীবকোষ বা সেলের রিসেপ্টার প্রোটিন আঁকড়ে ধরে কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর ভাইরাস দেহকোষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং দ্রুত বংশবিস্তার করতে থাকে। এভাবে ভাইরাস মানুষ বা অন্য জীবকে আক্রান্ত করে।

কিন্তু ব্যাকটেরিয়া হলো একধরনের জীবাণু। জীবকোষের বাইরে স্বাধীনভাবে থাকা অবস্থায়ও এদের প্রাণ আছে। সাধারণত এককোষী জীবাণু। এরা শরীরের ভেতরে বা বাইরে থাকে। কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়া শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। অবশ্য অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া শরীরের জন্য উপকারীও হয়। ব্যাকটেরিয়া যেহেতু জীবকোষ, তাই এরা নিজেরাও ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হতে পারে।

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে আমাদের কখনো জ্বর বা কঠিন রোগ হলে ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেন। অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক দেন। কাজ হয়। অ্যান্টিবায়োটিক হলো একধরনের রাসায়নিক পদার্থ। ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে খেলে বা ইনজেকশন হিসেবে গ্রহণ করলে এরা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার কোষে ঢুকে তাকে ধ্বংস করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের চিকিৎসা করা সম্ভব না। কারণ, ভাইরাস কোনো জীবকোষ না, কিন্তু ব্যাকটেরিয়া জীবকোষ। তবে কোনো কোনো অ্যান্টিভাইরাল (অ্যান্টিবায়োটিক নয়) ওষুধ জীবকোষের ভেতরে ঢুকে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে কিংবা ভাইরাসের কোষে ঢোকা ঠেকিয়ে দিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা সীমিত। অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা এন্টিভারইরাল ওষুধ উভয়ই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করতে হয়। রোগ অনুযায়ী কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ৩, ৫, ৭, ১৪ দিন বা তারও বেশি দিন খেতে হয়। দু–চার দিন পর রোগলক্ষণ (যেমন: জ্বর) চলে যেতে পারে। তখন ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলে পরবর্তী সময়ে আবার রোগ হলে ওই অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ নাও হতে পারে। যিনি এন্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করেন না, শুধু তার ক্ষেত্রে নয়, এমনকি তার সংস্পর্শে আসা মানুষদের জন্যও ওই অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকে হয়তো কয়েক ধরনের জ্বর, সর্দি–কাশি ভালো হয়ে যায়, কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণে কোনো ফল পাওয়া যায় না।

যদিও ভাইরাস নির্মূলে অ্যান্টিবায়োটিক কাজে লাগে না, কিন্তু ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট কোনো অঙ্গের ক্ষত বা প্রদাহ প্রভৃতি ধরনের সংক্রমণ রোধে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে না।

গুটিবসন্ত, জলবসন্ত, মাম্পস, হাম, রুবেলা প্রভৃতি ভাইরাসজনিত রোগ। আর এখন তো সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের অতিমারির শিকার। ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করার জন্য মূলত দরকার টিকা বা ভ্যাকসিন। টিকার মূল কাজ হলো দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলা। বিশেষ পদ্ধতিতে টিকা তৈরি করা হয়। যেমন করোনার টিকা শরীরে ঢোকানো হলে এর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু টিকার ফলে দেহে কোনো করোনার বিস্তার ঘটে না। অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা করোনারোধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে দেহে ঢুকলেও অ্যান্টিবডির আক্রমণে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অথবা কিছুটা সফল হলেও করোনা সংক্রমণের তীব্রতা বাড়তে পারে না। রোগী দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন। অন্যান্য ধরনের ভাইরাসের ক্ষেত্রেও টিকা কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। তবে ভাইরাসের রকমভেদে টিকার ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডির মেয়াদ কমবেশি হয়। সে জন্য কোনো কোনো ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর টিকা নিতে হয়। আবার কোনো কোনো ভাইরাসের ধরন বদলায়, তাই নতুন ধরনের ভাইরাস রোধে প্রায় প্রতিবছরই টিকা নিতে হয়।