এই তীব্র গরমে ‘আইসক্রিম’ শব্দটা শুনলেই জিবে জল আসে, মুখ ভরে আসে লালায়। দেখতে খুব নিরীহ বা খুব লোভ জাগানিয়া হলেও এর রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল।
আইসক্রিম বানাতে মোটামুটি তিনটা জিনিস হলেই চলে। দুধ, ক্রিম আর চিনি। এই তিনটি জিনিসকে নিম্ন তাপমাত্রায় জমিয়ে ফেললেই ভালো আইসক্রিম কিন্তু হয় না। আইসক্রিম এক ধরনের ইমালসন । ইমালসন জিনিসটা আসলে ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থ এবং জলের মিশ্রণ। মজার বিষয় হচ্ছে, বিশেষ প্রক্রিয়ায় না মেশালে এরা মেশে না। একটা ইমালসনে ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থের অতি ছোট কণা বা ড্রপলেট জলের মধ্যেই ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়, আলাদা হয়ে যায় না। এই যে ঘটনাটা ঘটছে, ফ্যাট-জল আলাদা হচ্ছে না, তা মূলত ইমালসনের অণুর রাসায়নিক ধর্মের কারণেই হয়।
আইসক্রিমে যে ফ্যাট ড্রপলেট থাকে, তা আসে ক্রিম থেকে।এই ফ্যাটগুলোর বেশির ভাগ অংশই ট্রাইগ্লিসারাইডস। এ ছাড়া সামান্য পরিমাণে থাকে অন্য ফ্যাটও। যেমন ফসফোলিপিডস এবং ড্রাইগ্লিসারাইডস (এদের পরিমাণ থাকে ২ শতাংশের কম)। ট্রাইগ্লিসারাইড তিন ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড অণু দিয়ে তৈরি হয়। আইসক্রিমে ব্যবহৃত ফ্যাটের গলনাঙ্ক বেশি হলে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো মুখের ভেতর মোমের মতো অস্বস্তিকর এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেবে। আবার গলনাঙ্ক যদি কম হয়, সে ক্ষেত্রে মুশকিল হবে আইসক্রিমের গঠন টিকিয়ে রাখা। সুখের কথা হলো, ডেইরি ফ্যাটের গলনাঙ্ক পড়েছে একেবারে ঠিকঠাক সীমার মধ্যে! ডেইরি ফ্যাট, পাম অয়েলের ফ্যাট, নারকেল তেলের ফ্যাট—এদের গলনাঙ্ক একই। তাই এগুলো দিয়েও চমৎকার আইসক্রিম বানানো সম্ভব।
আইসক্রিমের ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থ পানি আলাদা হওয়া ঠেকাতে আরও বেশ কিছু ব্যাপার এখানে একই সঙ্গে কাজ করে। দুধের প্রোটিন এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করে। আইসক্রিম বানানোর সময় খুব উচ্চ চাপে ছোট্ট একটা ভালভের মধ্য দিয়ে ফ্যাট বের করা হয়, তখন ফ্যাট ভেঙে তৈরি হয় ড্রপলেটস। তখন দুধের প্রোটিন এই ড্রপলেটসের গায়ে লেগে গিয়ে একটা খুব পাতলা আবরণ তৈরি করে। প্রোটিনের এই পাতলা আবরন ফ্যাট ড্রপলেটসগুলোকে আর একসাথে মিলে বড় ড্রপলেট তৈরি করতে দেয় না। প্রতিটি ছোট ড্রপলেটের প্রোটিনের পাতলা আবরণ আর একটা ড্রপলেটকে কাছে আসতে দেয় না। দূরে ঠেলে দেয়।
ইমালসিফায়ারের কথা বাদ গেছে, এরাও আইসক্রিম তৈরিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ইমালসিফায়ারদের একটা অংশ পানিতে দ্রবীভূত হয় আর আরেকটা অংশ দ্রবীভূত হয় ফ্যাটে। এই ইমালসিফায়াররা তখন আলাদা স্তর তৈরি করতে না দিয়ে নিজের দুই অংশ দিয়ে ফ্যাট এবং পানি একসঙ্গে আটকে রাখে।
একটা আইসক্রিমে ইমালসিফায়ারের যে ভূমিকা থাকে, তা নামের একটু বিপরীতে কাজ করে। এরা মূলত উপস্থিত থাকে কিছু ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থের ডি-ইমালসিফাইয়ের জন্যে। ফ্যাট ড্রপলেটের ওপর দুধের প্রোটিনের যে পাতলা স্তরটা থাকে, তার কিছু অংশ সরিয়ে কাজটা করে। ফলে ফ্যাটের কিছুটা অংশ বড় গাঁট বাধে এবং থোকা ধরে আইসক্রিমের কাঠির সঙ্গে আটকে থাকে। এ ছাড়া আইসক্রিমের কিছু ফ্যাটের ডি-ইমালসিফিকেশনের প্রয়োজন আইসক্রিমের ভেতরে বাতাস আটকানোর জন্যে।
আইসক্রিম যখন বানানো হয়, তখন একই সঙ্গে ঠান্ডায় জমাট বাঁধার পাশাপাশি তাতে বাতাসও প্রবাহিত করা হয়। ফ্যাট, প্রোটিন এবং ইমালসিফায়ার কম্বিনেশনের জন্যে বাতাসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইসক্রিমের যেখানে ফ্যাট আর প্রোটিন উপস্থিত থাকে না, সেখানে বাতাস মেশানো বেশ কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরবেটসের (sorbets) কথা। ভালো মানের আইসক্রিমে বাতাস কম থাকলেও ঘনত্ব থাকে খুব বেশি। আইসক্রিমে যদি বাতাসের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে তা গলে যায় দ্রুত।
ফ্রিজিং বা শীতলীকরণ আইসক্রিমের বরফ বা আইস বানানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আধুনিক আইসক্রিম ফ্যাক্টরিগুলো প্রয়োজনীয় নিম্ন তাপমাত্রার জন্যে তরল অ্যামিনিয়া ব্যবহার করে। এর আগে জলের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে এর গলনাঙ্ক -২১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নিয়ে আসা হতো। হাতে অ্যামোনিয়া আসার পর তার গলনাঙ্ক গিয়ে নেমেছে -৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। রেফ্রিজারেটর যত ঠান্ডা হবে আইসক্রিম তৈরি হবে তত দ্রুত।
আইসক্রিম বানানো হয় একটা ব্যারেলের ভেতর, তাতে স্ক্র্যাপার (scraper) ব্লেইড থাকে। আইসক্রিম ব্যারেলের গা স্পর্শ করামাত্র জমে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই স্ক্র্যাপার ব্লেইড ব্যারেলের গা থেকে চেঁছে আইসক্রিম সরিয়ে নিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর বরফের ক্রিস্টাল বা স্ফটিক খুব ছোট আকারে আইসক্রিমের সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যায়। আমাদের চাহিদাই হচ্ছে বরফের খুব ছোট ছোট টুকরো, যাতে করে আইসক্রিম হয় মসৃণ।
আইসক্রিমের আরেকটি মূল উপাদান চিনি। আইসক্রিম মিষ্টি করার পাশাপাশি এটি আইসক্রিমের জলের হিমাঙ্ক নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে। চিনির পরিমাণ এবং ধরনের ওপর নির্ভর করে আমরা আইসক্রিম কতটা শক্ত হবে বা নরম, তা নির্ধারণ করতে পারি। যে তরল সিরাপের মধ্যে ফ্যাট ড্রপলেট এবং বাতাসের বুদবুদ আটকে থাকে, সেই তরল সিরাপের সান্দ্রতার (viscocity) ওপরেও চিনির প্রভাব রয়েছে।
এ ছাড়া রয়েছে স্ট্যাবিলাইজার। এটিও তরলের সান্দ্রতার ওপর প্রভাব ফেলে। এই স্ট্যাবিলাইজাররা জলে দ্রবীভূত হয় , এদের উৎস হচ্ছে গাছ, আইসক্রিম গঠনে এরও রয়েছে বেশ ভালো ভূমিকা। খুব বেশি যে স্ট্যাবিলাইজারটি ব্যবহার করা হয়, এর নাম সোডিয়াম অ্যালজিনেট (sodium alginate), তৈরি হয় বাদামি সামুদ্রিক গুল্ম থেকে। এ ছাড়া আরেকটি স্ট্যাবিলাইজার আছে, নাম কারাগিনান (carrageenan), তবে মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে এই বস্তু খুবই কম ব্যবহার করা হয়। স্ট্যাবিলাইজার আইসক্রিমের উপরিভাগ বেশ মসৃণ করে এবং গলনাঙ্কও বাড়ায়।
আইসক্রিমের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান হচ্ছে এর সুগন্ধ। আইসক্রিমে ইচ্ছেমতো সুগন্ধি ব্যবহার করা যায়। যেমন ভ্যানিলা ফ্লেভারের কথাই ধরা যাক। প্রাকৃতিক ভ্যানিলা ফ্লেভারের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ভ্যানিলার কৃত্রিম ফ্লেভারও আইসক্রিমে দেওয়া যায়। একইভাবে প্রতিটি ফ্লেভারের ক্ষেত্রেই একই কথা খাটে। প্রাকৃতিক ফ্লেভারের বদলে কৃত্রিম ফ্লেভারও ব্যবহার করা যায়। প্রাকৃতিক রং, যেমন অ্যান্থোসায়ানিন (anthocyanins) ইত্যাদি রং দিয়ে আইসক্রিমকে করে তোলা যায় রংচঙে।
লেখক: কো-অর্ডিনেটর, স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস,ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া