পর্যায় সারণি ও কোয়ান্টাম মেকানিকস

দেড় শ বছর আগে দিমিত্রি মেন্ডেলিভ যখন পর্যায় সারণি নামের গল্প লিখতে বসলেন, তখন সে গল্পের চরিত্র ছিল ৬৩টি মৌল। দিন গড়িয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে আরও অনেক নতুন মৌল, কলেবর বেড়েছে পর্যায় সারণির। আজকের মানুষ ল্যাবে বসে বানাতে শিখেছে সিনথেটিক মৌল। কিন্তু মৌলের ধর্ম, বিন্যাস আর বৈশিষ্ট্যের পর্যায়ক্রমিক আবর্তনে পর্যায় সারণির ধারণা বরাবরই মুগ্ধ করেছে রসায়নবিদদের।

প্রথম মেন্ডেলিভ পারমাণবিক ভর অনুযায়ী পর্যায় সারণির মৌলগুলোকে সাজাতে চেয়েছিলেন, ব্যাপারটা এ রকম নয়। বরং পারমাণবিক ভর, মৌলের বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম সম্পর্কে কেমন করে ভবিষ্যদ্বাণী করে—মেন্ডেলিভ সে সম্পর্কেই ধারণা দিয়েছিলেন প্রথম।

১৮৬৯ সাল। মেন্ডেলিভ যখন প্রথম তাঁর করা পর্যায় সারণির ধারণা প্রকাশ করেন, তখনো আবিষ্কৃত হয়নি গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম বা স্ক্যান্ডিয়াম। কিন্তু মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণিতে অবস্থান অনুযায়ী এগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল স্পষ্ট!

এরপর প্রায় দেড় শ বছর ধরে রসায়নবিদেরা পারমাণবিক ধর্ম ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেছেন পর্যায় সারণি। পরীক্ষাগারে বড় বড় সব গবেষণায় নিয়েছেন অনুপ্রেরণা। জে জে থমসন থেকে আরউইন শ্রোডিঙ্গার—পরমাণুর গঠন কিংবা কোয়ান্টাম মেকানিকস—মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণি ব্যবহৃত হয়েছে সর্বত্র। মেন্ডেলিভ জানতেন না মৌলগুলোর ধর্ম কেমন করে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। বিজ্ঞানীদের বদান্যতায় এখন আমরা জানি, মৌলগুলোর ধর্মের ক্রম আবর্তনের নেপথ্যে মূল ভূমিকায় পরমাণুর গঠন।

বিশ শতকের শুরুতে পদার্থবিদ চার্লস গ্লোভার বার্কলে এবং আর্নস্ট রাদারফোর্ড খেয়াল করলেন, পরমাণুর কেন্দ্রে যে চার্জ, তা এর পারমাণবিক ভরের প্রায় অর্ধেক। ১৯১১ সালে পেশায় অর্থনীতিবিদ এক ডাচ বিজ্ঞানী এন্তোনিয়াস ভ্যান ডার ব্রুকের এক ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। তিনি ‘আলফন’ নামে একক ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট একটা মৌলিক কণিকার ধারণা দিলেন। তা ভরের দিক থেকে হিলিয়ামের অর্ধেক। ব্রুক বললেন, হাউড্রোজেন ছাড়া বাকি সব মৌল একাধিক আলফনের সমন্বয়েই তৈরি।

ভ্যানডার ব্রুকের আলফন কণার অস্তিত্ব আদতে কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও এটি জন্ম দিয়েছিল পারমাণবিক সংখ্যা ধারণাটির। কোনো পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে ঠিক যতগুলো প্রোটন থাকে, সেটিই মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা। পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোর অবস্থান নির্ধারণে এবার ব্যবহার শুরু হলো পারমাণবিক সংখ্যা। পারমাণবিক ভর পর্যায় সারণিতে বিদ্যমান যেসব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, পারমাণবিক সংখ্যা এসে সেসব সমাধান করল সহজেই। পদার্থবিদ হেনরি মোসলে ১৯১৩ সালের দিকে এক্স–রে বর্ণালিমীতি ব্যবহার করে পর্যায় সারণির ভিত্তি হিসেবে পারমাণবিক সংখ্যাকেই বসালেন।

১৯২০ সালের দিকে এসে কোয়ান্টাম মেকানিকস আমাদের চিন্তার জগৎকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছিল। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ইলেকট্রনের অবস্থান ও ঘূর্ণনের ধারণাকেই বদলে দিল কোয়ান্টাম মেকানিকস। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বলে, একটা ইলেকট্রনের অবস্থান ও গতিবেগ একই সঙ্গে একই সময়ে বের করা অসম্ভব। তাই যে মুহূর্তে আমরা ইলেকট্রনের অবস্থান জানব, ঠিক সে মুহূর্তে তার গতিবেগ জানতে পারব না। আবার যে মুহূর্তে গতিবেগ জানব, ঠিক সে মুহূর্তে তার অবস্থান জানা অনিশ্চিত।

হাইজেনবার্গের এ অনিশ্চয়তা নীতির আরেকটি বিষয়কে বাতিল করে দেয়। সেটা নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে ইলেকট্রনের অবস্থান নির্ণয়ের মডেল। একটা নির্দিষ্ট সময়ে নিউক্লিয়াসের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে ইলেকট্রনের অবস্থান নিশ্চিত করে বলা না গেলেও মোটামুটি সম্ভাবনা হিসাব করা যায়। নিউক্লিয়াসের চারপাশে যে ত্রিমাত্রিক জায়গাজুড়ে ইলেকট্রন পাওয়ার সম্ভাবনা, মোটামুটি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ সেটাকে বলা হয় পারমাণবিক অরবিটাল। শক্তি ও আকার অনুযায়ী এ অরবিটালগুলোকে ভাগ করা হয় s, p, d, f এসব নামে।

ইলেকট্রনের অবস্থান নির্ণয়ে কোয়ান্টাম মেকানিকস পরমাণুর গঠনকে নতুন করে ব্যাখ্যা করল। শুধু তা–ই নয়, পর্যায় সারণির ভিত্তি বা মৌলগুলোর ধর্মের ক্রম আবর্তনের পালেও নতুন হাওয়া যোগ করে। প্রতি অরবিটালে ঠিক কতটি ইলেকট্রন থাকতে পারে, কোয়ান্টাম মেকানিকস সেটা নির্ধারণ করে দেয়। যেমন হাইড্রোজেনের একটি ইলেকট্রনের অবস্থান 1s অরবিটালে, হিলিয়ামের দুইটা ইলেকট্রনেরও তা–ই। আবার তিন ইলেকট্রনবিশিষ্ট মৌল লিথিয়ামের সর্বশেষ ইলেকট্রনটি যায় 2s অরবিটালে। ইলেকট্রন কোন অরবিটালে এসে আগে ঢুকবে, তার ক্রম পর্যায় সারণির প্রথম তিন পর্যায়ের মৌলের ক্ষেত্রে খুব পরিষ্কার ও স্পষ্ট। কিন্তু সমস্যা বাধে চতুর্থ পর্যায়ে এসে। পটাশিয়াম (পারমাণবিক সংখ্যা 19) ও ক্যালসিয়ামের (পারমাণবিক সংখ্যা 20) সর্বশেষ ইলেকট্রন 3d–তে না বসে 4s অরবিটালে বসে। স্ক্যান্ডিয়াম (পারমাণবিক সংখ্যা 21) থেকে শুরু করে বাকি অবস্থান্তর মৌলগুলোর সর্বশেষ ইলেকট্রন 4p–তে না বসে 3d–তে বসে। 3d–এর আগে 4s কিংবা 5s–এর আগে 4p অরবিটালে ইলেকট্রন ঢোকার এ নিয়ম নির্ধারণ এই নীতিকে বলে আউফবাউ নীতি (পদার্থবিদ আরউইন ম্যাডেলাংয়ের নাম অনুযায়ী একে আবার ম্যাডেলাং নীতিও বলা হয়)। আউফবাউ নীতি মেনে নিলে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায় সহজেই। কিন্তু আউফবাউ নামের নীতিটি আসলে কোয়ান্টাম মেকানিকস বা পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব থেকে আসা কোনো নীতি নয়।

১৯৬৯ সালে পর্যায় সারণির এক শ বছর পূর্তিতে রসায়নবিদেরা এটিকে থিওরেটিক্যাল রসায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ৫০ বছর পার করে এসে ২০১৯ সালে এটিকে এখনো একটি তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা হয়!

মজার ব্যাপার হলো, পর্যায় সারণিতে এমন ২০টি মৌল আছে, যারা আউফবাউ নীতি মানে না। যেমন ধরা যাক, ক্রোমিয়াম (পারমাণবিক সংখ্যা 24)। আউফবাউ নীতি অনুযায়ী এর 3d অরবিটালে 4টি ও 4s অরবিটালে 2টি ইলেকট্রন থাকার কথা। কিন্তু ক্রোমিয়ামের বর্ণালি ডেটা পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া যায় অন্য কিছু। আদতে এর 3d–তে 5টি ও 4s অরবিটালে ইলেকট্রনের দেখা মেলে 1টি। ক্রোমিয়াম ছাড়াও এ ধরনের ব্যাপার লক্ষ করা যায় কপার, নিওবিয়াম, রুথেনিয়ামসহ আরও ডজনখানেক মৌলের ক্ষেত্রে।

কোয়ান্টাম মেকানিকস আউফবাউ নীতিকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না আবার আউফবাউ নীতি দিয়ে সব মৌলের ইলেকট্রন নীতিও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ২০০৬ সালে এ সমস্যার একটি সমাধান দিতে চেষ্টা করলেন তাত্ত্বিক রসায়নবিদ ইউগ্যান শোয়ার্জ। প্রোবাবিলিটি থিওরি বলে, একটি পরমাণুর পক্ষে একই সময়ে একাধিক ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করা সম্ভব। কাজেই একটি নির্দিষ্ট শক্তিতে একটি ইলেকট্রনকে একের বেশি অরবিটালে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে প্রোবাবিলিটি থিওরি ও কোয়ান্টাম মেকানিকস। পরমাণুর স্থায়ী ইলেকট্রন বিন্যাস খুঁজে পেতে এসব সম্ভাবনাকেই এক করতে হয়। শোয়ার্জ ঠিক তা–ই করলেন এবং কোয়ান্টাম ও স্ট্যাটিসটিক্যাল মেকানিকসের প্রোবালিটি থিওরিকে কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ মৌলের ক্ষেত্রে ইলেকট্রন বিন্যাস ব্যাখ্যা করতে পারলেন। সেগুলো আবার আউফবাউ নীতিকেও মেনে চলে।

পরমাণুর অরবিটালে ইলেকট্রন প্রবেশের ক্ষেত্রে আউফবাউ নীতি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। তবে পরমাণু ইলেকট্রন ছেড়ে দিয়ে আয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতি একদমই উল্টো। যেমন অবস্থান্তর মৌল স্ক্যান্ডিয়ামের ক্ষেত্রে এর সর্বশেষ ইলেকট্রনটি 3d–তে বসে। কিন্তু ইলেকট্রন ছেড়ে দিয়ে আয়ন হওয়ার সময় স্ক্যান্ডিয়াম সবার আগে ইলেকট্রন ছাড়ে 4s থেকে। শোয়ার্জ ও তার দল ২০১০ সালে এই সমস্যার আলাদা একটি সমাধান দেন। সেটা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করেই। পরীক্ষাগারে তৈরি করা বর্ণালি ডেটা ব্যবহার করে শোয়ার্জ দেখালেন স্ক্যান্ডিয়ামের সর্বশেষ ইলেকট্রনটি যে কেবল 4s অরবিটালে ঢুকে করে তা নয়, প্রতিটা মৌলের পারমাণবিক অরবিটালের শক্তিক্রমও নিজস্ব! যেমন স্ক্যান্ডিয়ামের ক্ষেত্রে 4s–এর চেয়ে 3d অরবিটাল কম শক্তির!

ইউগ্যান শোয়ার্জের এ গবেষণালব্ধ ফলাফল পর্যায় সারণির মৌলগুলোর ধর্মের পর্যায়ক্রমিক আবর্তনে ইলেকট্রনের বিন্যাসের যে ভিত্তি, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সেই সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করে প্রতিটা মৌলের স্বকীয় কাঠামো ও শক্তির বিন্যাস খুঁজে বের করায় নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। তবে আশার কথা, পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোর অবস্থান এবং ইলেকট্রন বিন্যাস ব্যাখ্যায় আউফবাউ বা ম্যাডেলাং নীতি এখনো গ্রহণযোগ্য বলেই মেনে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। নয়তো আমাদের পাঠ্যবইয়ের পর্যায় সারণির ইলেকট্রন বিন্যাসের ব্যাখ্যা পাল্টে দিয়ে নতুন করে লিখতে হতো!

মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণি আজ দেড় শ বছর পার করতে চলেছে। কিন্তু এর সব রহস্যের খোলস অবমুক্ত করা সম্ভব হয়নি এখনো। পদার্থবিদ, রসায়নবিদ ও বিজ্ঞানের দার্শনিকদের কাছে পর্যায় সারণি এখনো এক মায়াপুরী। নিত্যনতুন তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গবেষণা এর প্রজ্জ্বলিত সলতেটাই পাল্টে যাচ্ছে কেবল।

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার, উইকিপিডিয়া