বেগুনের কী গুণ

বাঙালির ‘ভেতো’ বলে একটা দুর্নাম আছে। আমরা নাকি খালি ভাত খেতে পছন্দ করি। কথাটা একটা শ্রেণির জন্য আসলেই সত্য। আমার নিজের কথাই বলি, বিদেশের দুর্দান্ত বেতনের চাকরি ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি শুধু দুবেলা ভাত খেতে পাচ্ছি না বলে।

মাত্র চুলা থেকে নামানো ঝরঝরে সাদা, হিলহিলে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে কড়কড়ে করে ভাজা বেগুন। খাঁটি গাওয়া ঘি ছড়িয়ে সামান্য লবণ দিয়ে মেখে খেতে অমৃত মনে হয়।

বেগুন শব্দটার একটা চমৎকার ইতিহাস আছে। ব্রিটেনে বেগুনকে এগপ্ল্যান্ট বলা হয়, আবার ঔবেরজিনও বলে। এই শব্দটা ধার করা হয়েছে আরবি শব্দ আল-বাদিনজান থেকে। পারসিয়ানদের মাধ্যমে বেগুনের সংস্কৃত নাম ভাতিমগন গিয়েছে অ্যারাবিয়ানদের কাছে। ভারতবর্ষে সেই সংস্কৃত যুগ থেকেই তাহলে বেগুনের চাষাবাদ ছিল, না হলে নাম থাকে কেমন করে?

এই বেগুন আসলে একটা ফল, সবজি নয়। এই বেগুনের বিবিধ জাত আছে। এই জাতগুলো যে শুধু রঙেই আলাদা, ব্যাপারটা এমন নয়। কিছু বেগুন দেখা যায় গাঢ় বেগুনি রঙের আবার কিছু আছে হালকা বেগুনি কিংবা একেবারে সবজেটে সাদা। এর কারণটা হচ্ছে অ্যান্থোসায়ানিন। এই পিগমেন্ট বা কোষীয় রঞ্জক কোনো ফলে লাল, নীল অথবা বেগুনি রংও দিতে পারে। ধরুন গাজর, ওখানে রং প্রায় কমলা, দায়ী এই অ্যান্থোসায়ানিন।

বেগুনে নানা ধরনের অ্যান্থোসায়ানিন থাকে, জাতের ওপর এবং সেই জাতে বিবিধ অ্যান্থোসায়ানিনের উপস্থিতির পরিমাণের ওপর রঙের খেলাটা দেখা যায়। এসব অ্যান্থোসায়ানিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে নাসুনিন। এই নামটা আবার এসেছে জাপানে বেগুনকে যে নামে ডাকা হয় নাসুবি, তা থেকে।

নাসুনিনের আবার দুটো আইসোমেরিক চেহারা আছে, সিস-নাসুনিন ও ট্রান্স-নাসুনিন। ট্রান্স–আইসোমারগুলো সাধারণত বেশি স্থির হয় এবং বেশি পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই আইসোমাররা দৃশ্যমান আলোর নিচে গাঠনিক আন্তপরিবর্তনও হয়।

অ্যান্থোসায়ানিন একধরনের ফেনোলিক যৌগ। বেগুনে এই বস্তু প্রচুর পরিমাণে থাকে। কাঁচা অবস্থায় তিতকুটে স্বাদের জন্যও এরাই দায়ী। শুধু তা–ই না, বেগুন কাটার পর ভেতরের অংশও বেশ দ্রুত বেগুনি রঙের হয়ে যাওয়ার কারণও এই অ্যান্থোসায়ানিন।

বেগুন কাটলে এর কোষের গঠন নষ্ট হয়। ফলে পলিফেনল অক্সিডেজ নামের এনজাইম অবমুক্ত হয়। এই এনজাইম বেগুনের মধ্যেই ফেনোলিক যৌগের গঠন অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কুইনোনে পরিবর্তন করে রং বদলে দেয়। যদিও বেশির ভাগের রংই হয় সাদা, তারপরও এই কুইনোনেরা নিজেরাই পলিমার গঠন করে। তখন তৈরি হয় জটিল গঠনের বাদামি রঙের পলিমার।

বাদামি রং যাতে না হয়, তার জন্য বেশ চমৎকার কিছু উপায় আছে। যেমন বেগুন কেটেই যদি লবণগোলা জলে বা লেবুর রস মেশানো জলে রাখা হয়, তাহলে রং আর বেগুনি হয় না। আবার কেউ কেউ বলেন, খুব ধারালো ছুরি দিয়ে কাটলে কোষের দেয়াল বেগুনি হওয়াটাকে আটকে দেওয়া যায়। কারণ সে ক্ষেত্রে কম নষ্ট বা ভাঙা কোষ থেকে কম পলিফেনল অক্সিডেজ বের হয়।

ধরুন বেগুন কাটার পর ভেতরের বেগুনি রং হওয়াটাকেও আটকে দিয়েছেন, কড়াইয়ে তেলে ভাজার আগে আরেকটা কাজ করা যায়। যাঁরা ডুবোতেলে বেগুন ভেজেছেন, তাঁরা জানেন যে বেগুন স্পঞ্জের মতো তেল শুষে নেয়। এর কারণ হচ্ছে, বেগুনের কোষীয় গঠনবিন্যাসে এয়ার পকেট বা বাতাসের ফাঁকা জায়গা থাকে। ভাজার সময় তা আকারে ছোট হয়ে গেলেও ভেতরের তেল শুষে নেয়।

এটা আটকানোর উপায়ও আছে। ভাজার আগে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করে নিলে বেগুনের সেই ফাঁকা এয়ার পকেট সংকুচিত হয়ে যায়। আরও সহজ উপায় হচ্ছে বেগুন কেটে তাতে লবণ মাখিয়ে রাখা। এতে বেগুনের ভেতরের জল অসমোসিস বা অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায়। এতেও বেগুনের কোষীয় বিন্যাসের সেই এয়ার পকেট নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় বেগুন কেটে লবণ মাখিয়ে আধা ঘণ্টা রেখে রান্না করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া

সূত্র: কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট