যেভাবে পেলাম আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি

নতুন কিছু আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এসব নামের পেছনেও লুকিয়ে থাকে মজার ইতিহাস

উনিশ শতকের শেষ দিকের ঘটনা। ইউরেনিয়ামের একটা যৌগ থেকে রহস্যময় আলো নিঃসৃত হতে দেখেন ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল। সে রহস্য সমাধান করেন তাঁরই ছাত্রী বিজ্ঞানী মেরি কুরি। ১৮৯৮ সালে মেরি প্রমাণ করেন, এই বিকিরণের জন্য আসলে দায়ী ইউরেনিয়াম পরমাণু। ইউরেনিয়ামকে রেডিও–অ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয় উপাদান হিসেবে নামকরণও করলেন মেরি কুরি। এটাও প্রমাণ করেন, থোরিয়াম নামের আরেকটি মৌলও তেজস্ক্রিয়।

পরে পরীক্ষায় দেখা গেল, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম মৌল থেকে তিন ধরনের বিকিরণ নিঃসৃত হয়। চুম্বকের উপস্থিতি এই বিকিরণের কিছু অংশ একদিকে সামান্য একটু বেঁকে যায়। আর বিকিরণের কিছু অংশ আরেক দিকে বেঁকে যায় এবং পরিমাণ বেশি। কিন্তু বিকিরণের একটা অংশ সোজা পথে চলতে থাকে, যেন সেখানে কোনো চুম্বকের উপস্থিতি নেই।

এই তিন ধরনের বিকিরণকে গ্রিক বর্ণমালার তিনটি বর্ণ দিয়ে নামকরণ করলেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। যে বিকিরণটা একটু বেঁকে যায়, তার নাম দিলেন গ্রিক বর্ণমালার প্রথম বর্ণ দিয়ে—আলফা রে বা আলফা রশ্মি। যে বিকিরণটা আরেকটু বেশি বাঁকে, তার নাম দিলেন দ্বিতীয় বর্ণ দিয়ে—বিটা রে বা বিটা রশ্মি। আর যে বিকিরণ বেঁকে যায় না, তার নামকরণ গ্রিক বর্ণমালার তৃতীয় বর্ণ অনুযায়ী করা হলো গামা রে বা গামা রশ্মি।

কিছু পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেল, আলফা কণা আসলে হিলিয়াম আয়ন। এতে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন থাকে। ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর চার গুণ। এর গতিবেগ আলোর বেগে ১০ ভাগের ১ ভাগ। ভর বেশি হওয়ার কারণে আলফা কণার ভেদনক্ষমতা কম। একটা পাতলা কাগজ দিয়েও এ কণার গতিপথ থামানো সম্ভব। তবে তীব্র আয়ন সৃষ্টির ক্ষমতা থাকায় এ কণা ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। সাধারণত ভারী কোনো পরমাণু থেকে আলফা কণা বেরিয়ে যাওয়ার কারণে তার পরমাণুটির ভরসংখ্যা কমে যায়। পরিণতিতে তা অন্য মৌলে পরিণত হয়। পারমাণবিক ট্রান্সমিউটেশন। যেমন আলফা ক্ষয়ের কারণে যখন ইউরেনিয়াম থোরিয়াম হয়ে যায় বা রেডিয়ামটি রেডন গ্যাসে পরিণত হয়।

বিটা রশ্মি আলফা রশ্মির চেয়ে বেশি বেঁকে যায়। এর কারণ এদের ভর কম। ১৯০০ সালের দিকে বেকেরেল প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন যে বিটা কণা আসলে খুব হালকা। কারণ, এগুলো আসলে উচ্চশক্তির ইলেকট্রন বা পজিট্রন কণা। ভেদনক্ষমতাও আলফা কণার চেয়ে বেশি। তিন সেন্টিমিটার অ্যালুমিনিয়ামের পাতও ভেদ করে চলে যেতে পারে বিটা কণা।

গামা রশ্মি কোনো দিকেই বেঁকে যায় না। কারণ, এই রশ্মি চার্জনিরপেক্ষ। তাই এটি চুম্বক বা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের কারণে প্রভাবিত হয় না। এটি একধরনের উচ্চশক্তির বিদ্যুচ্চৌম্বকীয় বিকিরণ। পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের কারণে এই বিদ্যুচ্চৌম্বকীয় বিকিরণ নিঃসৃত হয়। তিন ধরনের বিকিরণের মধ্যে গামা রশ্মির ভেদনক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এর গতিপথ থামাতে কয়েক সেন্টিমিটার পুরু সিসার সিটের দরকার হয়। এর বেগ প্রায় আলোর বেগের সমান।