রসনার রসায়ন
সুস্বাদু খাবার রান্নার পর বাদামী হয় কেন?
একধরনের সিরিজ বিক্রিয়ার নাম মিলিয়ার্ড বিক্রিয়া। এ বিক্রিয়া আমাদের কাছে বিভিন্ন খাবার ও পানীয়কে আরও লোভনীয় করে তোলে। সুঘ্রাণ যেমন বাড়ায়, তেমনি খাবারকে দেয় বাদামী রং।
অনেক খাবারই রান্নার পর বাদামী হয়ে যায়। বিশেষ করে মাংসের স্টেক তৈরি করলে দেখা যায় বাদামী রং। আবার কফির মতো পানীয়র জন্যও এ কথা খাটে। কারণ, কফি বিনকেও রোস্ট করা হয়, মানে ভাজা হয়।
দোপেয়াজা, টোস্ট, স্টেক বা কফি—এরকম বাদামী রঙের খাবারগুলোর স্বাদের পেছনে রয়েছে বিশেষ একধরনের বিক্রিয়ার কারসাজি। অবশ্য সব খাবারের স্বাদের পেছনেই রসায়নের কারিকুরি আছে। খাবার খেতে স্বাদ লাগে, কারণ, খাবারের ভেতরের রাসায়নিক সুনির্দিষ্টভাবে বিক্রিয়া করে স্বাদটা বের করে আনে। তবে রান্না বা ভাজা খাবারের ক্ষেত্রে, যেসব খাবার বাদামী রঙের হয়ে যায়, সেগুলোর জন্য একটা বিশেষ বিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। নাম, মিলিয়ার্ড বিক্রিয়া। অনেকে একে বলেন, খাবারকে এনজাইম ছাড়াই বাদামী রঙে রাঙানোর উপায়।
বোঝাই যাচ্ছে, এই বিক্রিয়ার জন্য রান্না করা জরুরি। কারণ, বিক্রিয়াটি শুরু হয় তাপ দেওয়ার ফলে। খাবারে তাপ দিলে শুরু হয় এ সিরিজ বিক্রিয়া। শুরুটা হয় একটি প্রোটিনের সঙ্গে গ্লুকোজ বা ফ্রুক্টোজের মতো বিজারক শর্করার বিক্রিয়ার ফলে। এই বিজারক শর্করাগুলো আবার একধরনের স্যুগার বা চিনিও বটে। বিক্রিয়া হওয়ার ফলে খাবারে স্বাদ তৈরি হয়, সঙ্গে তৈরি হয় বাদামী রং।
ফরাসী রসায়নবিজ্ঞানী লুই ক্যামিল মিলিয়ার্ড প্রথম এই বিক্রিয়ার কথা বলেন ১৯১২ সালে। তিনি দাবি করেন, প্রোটিন ও চিনির মধ্যে এ বিক্রিয়া ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা এ বিক্রিয়ার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আরও বিশদ জেনেছেন।
তাপ যখন খাবারে পৌঁছায়, তখন বিজারক চিনি বিশেষ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। অনেকেই হয়তো জানেন, প্রোটিন তৈরি হয় অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে। অর্থাৎ চিনি এক্ষেত্রে প্রোটিনের সঙ্গেই বিক্রিয়া করে। এ বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় গ্লাইকোসাইলামিন নামে একধরনের রাসায়নিক। এটি অস্থিতিশীল। এর উপাদানগুলো পুনর্বিন্যস্ত হয়ে তৈরি করে কিটোস্যামিন নামে নতুন আরেক ধরনের রাসায়নিক। এর ফলেই শুরু হয় সিরিজ বিক্রিয়া। শ খানেকের বেশি নতুন যৌগ তৈরি হয় এসব বিক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে। এর কিছু ভূমিকা রাখে খাবারটির স্বাদে, বাকিগুলো তৈরি করে জিভে জল আনা সুঘ্রাণ। যেমন পাইরাজিন—এটি টোস্ট করা খাবারের স্বাদ তৈরি করে। এর সঙ্গে তৈরি হয় মিষ্টি স্বাদের ফিউরানন। আর বিক্রিয়ার একদম শেষের দিকের ধাপে এসে তৈরি হয় বিশাল এক পলিমার অণু—মেলানয়ডিন। এটাই খাবারকে বাদামী রং দেয়।
স্বল্প সময়ে মিলিয়ার্ড বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। এ বিক্রিয়ার জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ১১০ থেকে ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা আরও বেশি হলে খাবারে তিতকুটে স্বাদ চলে আসে। ঠিক ধরেছেন, পোড়া খাবার এজন্যই তেতো লাগে।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, উইকিপিডিয়া