ক্লিক রসায়ন এবং জৈব প্রক্রিয়ার গবেষণায় অসামান্য পদ্ধতি

ক্লিক রসায়ন, জৈবঅণু তৈরির অসাধারণ কিন্তু সরল এক পদ্ধতি ২০২২ সালে রসায়নে জিতে নিয়েছে নোবেল পুরস্কার। ব্যারি শার্পলেস, মর্টান মেলডাল এবং ক্যারোলিন বারতোজ্জির নোবেলজয়ী গবেষণার আখ্যান…

কোনো এক বিকেলে যদি হাঁটতে বেরোন কোনো বাজারে, সম্ভাবনা খুব বেশি, আপনি দেখবেন কেউ একজন আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রি করছে। অষ্টাদশ শতকে আধুনিক রসায়নবিদ্যা শুরুর আগে আয়ুর্বেদিক সমাধানই ছিল রোগ-শোক থেকে বেঁচে থাকার প্রধান উপায়। প্রকৃতিতে পাওয়া নানা উপাদানে কত রোগই তো ভালো হতো। তাই রসায়নবিদদের চেষ্টার বড় একটা অংশ জুড়ে সব সময়েই ছিল প্রাকৃতিক পদার্থ গবেষণাগারে তৈরি করা। এক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্যও অনেক।

সমস্যাটা অন্যখানে, সাড়ে শাতশ কোটি মানুষের পৃথিবীতে শুধু গবেষণাগারে রাসায়নিক বানানো গেলেই হবে না, শিল্প-কারখানাতেও বানানো চাই, যাতে সবার জন্য সহজলভ্য করা যায়। এক্ষেত্রেও রসায়নবিদদের সাফল্য ঈর্ষনীয়। তাই মাত্র একশ বছরে পৃথিবীর মানুষ যখন দুইশ কোটি থেকে সাড়ে সাতশ কোটি হয়ে গেছে, বিজ্ঞানীরা এতগুলো মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ঠিকই নতুন সব উদ্ভাবনের মাধ্যমে সম্ভব করেছেন। তবুও সব প্রাকৃতিক অণু কি গবেষণাগারে বা কারখানায় বানানো যায়? যায় না আসলে।

কিন্তু বেশ অগ্রগতি হয়েছে গত বিশ বছরে। এমনই এক অগ্রগতি ক্লিক রসায়ন, একদম খাপে খাপে মেলানোর রসায়ন। অসাধারণ, কিন্তু খুবই সরল এই পদ্ধতির ঘরে ২০২২ সালের রসায়নের নোবেল। এলিগ্যান্ট এই পদ্ধতির আইডিয়া দিয়েছেন ২০০১ সালের রসায়নের নোবেলজয়ী ব্যারি শার্পলেস, স্বাধীনভাবে কার্যকর এক উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন শার্পলেস এবং মর্টান মেলডাল। ক্লিক রসায়নকে ক্যারোলিন বারতোজ্জি অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বায়োঅর্থোগোনাল বিক্রিয়া আবিষ্কারের মাধ্যমে। তাই গতবার তিনজন ভাগাভাগি করেছেন রসায়নের নোবেল পুরষ্কার।

আবিষ্কারের এক যুগের ব্যবধানে রসায়নের জগতে এখন ক্লিক রসায়ন বা বায়োঅর্থোগোনাল বিক্রিয়া পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত নাম। কীভাবে এই প্রক্রিয়া কাজ করে বা এখন কী কাজে লাগে, তা দেখার আগে চলুন একটু জেনে আসা যাক, এই জায়গায় আমরা পৌঁছালাম কীভাবে।

কালো এবং সাদা বল যথাক্রমে কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণু, একটা কার্বন অন্য একটা কার্বনের সঙ্গে বন্ধন গঠন করে আরও তিনটা হাইড্রোজেনের সঙ্গে বন্ধন গঠন করতে পারে।

যাঁরা রাসায়নিক সিনথেসিস নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের অন্যতম মাথাব্যাথা থাকে জটিল কোনো অণু তৈরির ধাপসংখ্যা। দশ-বিশ ধাপ পেরিয়ে দেখা যায় কোনো একটা ব্যবহারোপযোগী পদার্থ তৈরি করা যায়। ধাপসংখ্যা বেশি হওয়ার সমস্যা অনেক, প্রতি ধাপেই দেখা যায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পদার্থ তৈরি হচ্ছে। যেগুলো আলাদা করা খুবই কঠিন কাজ। আরেকটা সমস্যা, প্রতি ধাপেই আকাংক্ষিত পদার্থ কমতে থাকে। এক কেজি বিক্রিয়ক নিয়ে শুরু করে দেখা গেল শেষে আপনি পেলেন কয়েক গ্রাম উৎপাদ। যা অনেক সময় হতাশাজনক। এরচেয়েও বড় সমস্যা, এসব প্রক্রিয়া লাভজনক উপায়ে কারখানায় তৈরি করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ওষুধ শিল্পের জটিল অণু এই সমস্যায় বেশি ভোগে।

পৃথিবীর প্রায় সব জৈবিক পদার্থের মূল কাঠামো হলো কার্বন। জীবজগতের সকল অণুর মেরুদণ্ড বলা যেতে পারে। এজন্য রসায়নের একটা প্রধান শাখা হলো অরগানিক কেমিস্ট্রি বা জৈব রসায়ন।

এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে এই শতাব্দীর শুরুতে অধ্যাপক ব্যারি শার্পলেস একটা পেপার লিখলেন, কীভাবে এমন একটা প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যায়, যাতে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এর নাম দিলেন ক্লিক রসায়ন। তিনি দেখালেন, কী উপায়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উপযোগী যৌগ সহজে তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। কী বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে ক্লিক রসায়ন বলা যাবে, তারও একটা ধারণা দিলেন। তার ছোট সেই ধারণা এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। চেক করে দেখলাম, ওই পেপারটা অন্তুত পনের হাজার বার অন্য বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

ওই পেপারেই শার্পলেস উদহারণ হিসেবে দেখিয়েছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনেম। প্রাকৃতিক উৎসে পাওয়ার পরে এই অ্যান্টিবায়োটিক বড় স্কেলে উৎপাদনের জন্য ছয় বছর গবেষণা করতে হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিক উপায়ে যদি পাওয়া যায়, গবেষণাগারে বানানো এত কঠিন কেন? প্রাকৃতিক উপায়ে অত্যন্ত জটিল সব প্রক্রিয়া খুব ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিনিয়ত হচ্ছে। যেমন আমাদের একেকটা কোষে, যা আমরা শক্তিশালী অণুবিক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখতে পাই না, হাজার হাজার জটিল প্রক্রিয়া চলছে। গবেষণাগারে ব্যাপারটা কঠিন কেন তা বুঝতে এসব প্রক্রিয়ার মূল কাঠামোটা একটু দেখা যাক।

পৃথিবীর প্রায় সব জৈবিক পদার্থের মূল কাঠামো হলো কার্বন। জীবজগতের সকল অণুর মেরুদণ্ড বলা যেতে পারে। এজন্য রসায়নের একটা প্রধান শাখা হলো অরগানিক কেমিস্ট্রি বা জৈব রসায়ন। কার্বন পরমাণু মেরুদণ্ড হিসেবে সফল, এর কারণ দুটি কার্বন পরমাণু খুব শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করতে পারে। শুধু দুটো কার্বন নয়, শত শত কার্বন একটার সঙ্গে একটা যুক্ত হয়ে লম্বা শেকল তৈরি করতে পারে। আরও চমৎকার ব্যাপার হলো, প্রতিটা কার্বন একসঙ্গে চারটা বন্ধন তৈরি করে। তাই অন্য এক বা একাধিক কার্বনের সঙ্গে বন্ধন গঠন করার পরেও তিন বা দুইটা বন্ধন তৈরির সক্ষমতা থাকে। কার্বনের এসব বন্ধন আবার খুবই শক্তিশালী, সহজে ভাঙা যায় না।

জৈব অণুগুলোর গঠন লক্ষ্য করলে দেখবেন, সেখানে একটা কার্বনের কাঠামো আছে, সঙ্গে আরও নানা ধরনের পরমাণু আছে, সাধারণত অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো, কার্বন কাঠামোর সঙ্গে যেসব পরমাণু যুক্ত হয়, সেগুলোর মধ্যেও এক ধরনের শৃংখলা আছে। অধিকাংশ সময় এসব পরমাণু যুক্ত হয় দল বেঁধে, যাকে রসায়নবিদরা বলেন গ্রুপ। যেমন একটা গ্রুপের নাম কার্বক্সিল গ্রুপ, একটা কার্বন, দুইটা অক্সিজেন এবং একটা হাইড্রোজেন মিলে হয় এই কার্বক্সিল গ্রুপ। কার্বক্সিলকে রসায়নবিদরা লিখবেন -COOH, হাইফেন দিয়ে বোঝায় এই অংশ দিয়ে গ্রুপটা একটা কার্বন কাঠামোর সঙ্গে বন্ধন গঠন করতে পারবে। এমনই দুটো গ্রুপ অ্যালকাইন এবং অ্যালকাইল হ্যালাইড নিয়ে আমরা আবার পরে আলোচনা করব।

সমস্যা বাঁধে শক্তিশালী কার্বনের বন্ধনের সঙ্গে কোনো কিছুর বিক্রিয়া ঘটাতে গেলে। এত স্থিতিশীল একটা বন্ধন ভেঙে অন্য কোনো গ্রুপ বা পরমাণু যুক্ত করতে গেলে আরও নানা ধরনের অণু তৈরি হতে শুরু করে। কারণ এসব বিক্রিয়া তো করা হয় কোনো একটা পাত্রে, এক একটা আলাদা অণু ধরে নয়, তাই একটা একটা অণু ধরে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

তাহলে উপায়? রসায়নবিদরা সাধারণত শুরু করেন খুবই সরল অণু থেকে। বিশেষ করে যেসব অণুর কোনো এক মাথায় অক্সিজেন, নাইট্রোজেন বা ক্লোরিন আছে। এসব পরমাণুর বন্ধন ভেঙে অন্য বন্ধন তৈরির প্রতি কিছুটা আকর্ষণ আছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামুলক সহজ। কিন্তু বাস্তবে এই পদ্ধতিতে জটিল অণু বানানো খুবই কঠিন।

ব্যারি শার্পলেসের পেপার প্রকাশ হয় মে মাসে। মাস খানেকের মধ্যেই আসলে ক্লিক কেমিস্ট্রির আইডিয়া সফলতার মুখ দেখে। এরপর আরও এমন অনেকগুলো ক্লিক রসায়নের বিক্রিয়া খুঁজে বের করেন মেলডাল।

ব্যারি শার্পলেস তাঁর ক্লিক রসায়নের আইডিয়াতে এসব সমস্যা তুলে ধরেই লেখেন, এভাবে যদি আমরা ঠিক প্রাকৃতিক অণুর নকল বানাতে নাও পারি, একই গুণ সম্পন্ন অন্য অণু বানাতে পারব, যা দিয়ে হয়ত কাজ চলবে। শার্পলেস যেসব শর্ত নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ছিল এসব বিক্রিয়া পানি এবং অক্সিজেনের উপস্থিতিতে করতে পারতে হবে। অর্থাৎ পানি বা অক্সিজেন বিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে না। কারণ যেখানে পানি বা অক্সিজেনের উপস্থিতি কোনোভাবে বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, সেসব বিক্রিয়া কারখানায় লাভজনক উপায়ে করা খুবই কঠিন।

খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি একটা পারফেক্ট ক্লিক রসায়নের উদহারণ পেতে। যা খাপে খাপে মিলে যাবে, অনাকাঙ্ক্ষিত পদার্থের অহেতুক উৎপাত সহ্য করতে হবে না।

ঘটনাটা ডেনমার্কে মর্টান মেলডালের ল্যাবে। আর শত শত অসাধারণ আবিষ্কারের মতো এই আবিষ্কারও সারপ্রাইজ থেকে। বিজ্ঞানীরা যখন গবেষণাগারে একটা পরীক্ষা করেন, ফলাফল বিশ্লেষণের সময় সবাই কমবেশি চোখ রাখেন, কোনো সারপ্রাইজ আছে কি না। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটা মানে সব সময় খারাপ না, অনেক সময়েই অপ্রত্যাশিত ভালো কিছুও পাওয়া যায়। এমনটাই ঘটেছে মেলডালের ল্যাবে।

এই শতাব্দীর শুরুতে মেলডাল শত শত অণুর মধ্য থেকে কোনগুলো ওষুধ শিল্পে কার্যকর হতে পারে, তার তালিকা তৈরি করছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে ল্যাবে খুবই সাধারণ একটা বিক্রিয়া করছিলেন তিনি এবং সহগবেষকরা। এই বিক্রিয়ার কথা মোটামুটি যেকোনো রসায়নবিদ খুব ভালো করে জানেন। কোনো একটা কার্বন কাঠামোর অণুতে দুটো কার্বনের মধ্যে যদি তিনটা বন্ধন থাকে, তাকে বলে অ্যালকাইন। আর কার্বন কাঠামোর কোনো একটা কার্বনের সঙ্গে যদি একটা ক্লোরিন, ফ্লোরিন বা ব্রোমিন পরমাণু থাকে, তাকে বলে অ্যালকাইল হ্যালাইড। অ্যালকাইন আর অ্যালকাইল হ্যালাইড যদি কোনো পাত্রে একত্রে রাখা হয়, এবং সেখানে যদি কপার আয়ন থাকে, অ্যালকাইন গ্রুপের সঙ্গে হ্যালাইড গ্রুপ খুব সহজেই বিক্রিয়া করে ফেলে। মেলডাল যখন পরীক্ষণের ফলাফল বিশ্লেষণ করছিলেন, অবাক হয়ে দেখলেন, এই দুই গ্রুপের সংযোগ হয়নি, অন্য কিছু উৎপন্ন হয়েছে।

তিনি যে অ্যালকাইল হ্যালাইড নিয়ে কাজ করছিলেন, ওই একই অণুর অন্য মাথায় ছিল আরেক গ্রুপ, অ্যাজাইড। অ্যাজাইড হলো পরপর তিনটা নাইট্রোজেনের একটা বিশেষ গ্রুপ (-N=N=N)। অ্যালকাইল হ্যালাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া না করে অ্যালকাইন বিক্রিয়া করেছে অ্যাজাইডের সঙ্গে। অ্যালকাইন আর অ্যাজাইড গ্রুপ মিলে একটা রিং বা চক্র তৈরি করেছে, যাকে রসায়নবিদরা বলেন ট্রায়াজল গ্রুপ।

রসায়ন, বিশেষ করে জৈব রসায়ন নিয়ে কাজ করলে আপনি জানবেন, ট্রায়াজল খুবই দরকারি রাসায়নিক গ্রুপ। এই গ্রুপ অনেক ধরনের ওষুধ, রঙ, সার, কীটনাশকে উপস্থিত। যেহেতু ট্রায়াজল দরকারি রাসায়নিক, বিজ্ঞানীরা আগেও অ্যালকাইন আর অ্যাজাইড থেকে ট্রায়াজল বানানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত অন্য পদার্থ উৎপন্ন হওয়ায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।

২০২২ সালে রসায়নে নোবেল পাওয়া তিন বিজ্ঞানী। বাঁ থেকে ক্যারোলিন বারতোজ্জি, মর্টান মেলডাল এবং ব্যারি শার্পলেস

মেলডাল দেখলেন, কপার আয়নের উপস্থিতি কোনো একভাবে অ্যালকাইনকে হ্যালাইডের দিকে আকর্ষিত না করে শুধু অ্যাজাইডের দিকেই আকর্ষিত করেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পদার্থও উৎপন্ন হয়নি। পানি বা অক্সিজেনের উপস্থিতি কোনো সমস্যা করেনি। যেন ঠিক ব্যারি শার্পলেসের ক্লিক কেমিস্ট্রি।

এই ফলাফল তিনি প্রথম প্রকাশ করেন ২০০১ সালের জুনে, ব্যারি শার্পলেসের পেপার প্রকাশ হয় মে মাসে। মাস খানেকের মধ্যেই আসলে ক্লিক কেমিস্ট্রির আইডিয়া সফলতার মুখ দেখে। এরপর আরও এমন অনেকগুলো ক্লিক রসায়নের বিক্রিয়া খুঁজে বের করেন মেলডাল। সেগুলো একত্র করে পরের বছর পূর্ণাঙ্গ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

এদিকে ব্যারি শার্পলেসও আলাদাভাবে একই বিক্রিয়া খুঁজে পান। তিনিও এই গবেষণা প্রকাশ করেন একই বছর মার্চে। মেলডালের পেপারের মাস খানেক আগে। তিনি এই বিক্রিয়াকে বর্ণনা করেন ক্লিক কেমিস্ট্রির আদর্শ উদহারণ হিসেবে।

মেলডালের এই আবিষ্কার রসায়নবিদদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায়। কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যদি দুটো অণুকে যুক্ত করার দরকার পড়ে, বিজ্ঞানীরা একটা অণুর মধ্যে অ্যাজাইড, অন্যটায় অ্যালকাইন যুক্ত করে দেন। এরপর কপার আয়নের উপস্থিতিতে এই দুই পদার্থ বিক্রিয়া করাতেই খাপে খাপে মিলে গেল। এ যেন ব্যাগ বা গাড়ির বেল্ট লাগানোর জন্য যে ক্লিপ ব্যবহার করি, তার মতো। ক্লিক শব্দ করে লেগে যায়, এরপর খাপে খাপে শক্তভাবে লেগে থাকে। ক্লিক রসায়ন নামটা যথার্থ হয়েছে বলা যায়। কপার আয়ন প্রভাবিত ওই বিক্রিয়ার একটা গালভরা নামও আছে, কপার ক্যাটালাইজড অ্যাজাইড-অ্যালকাইন সাইক্লোঅ্যাডিশন।

বায়োঅর্থগোনাল রসায়ন
বারতোজ্জির গবেষণা নতুন জগত খুলে দিল। জীবদেহের মধ্যেই কোনো ধরনের জৈবিক প্রক্রিয়াকে ব্যহত না করে বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক বিক্রিয়া করার উপায় খুঁজে পেলেন। বারতোজ্জি এর সুন্দর এক নাম দিলেন, বায়োঅর্থোগোনাল রসায়ন।

আজকাল ক্লিক রসায়নের এই পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়। কারণ ক্লিক রসায়নের এই পদ্ধতি এরপর অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ক্যারোলিন বারতোজ্জি।

বারতোজ্জি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তাঁর পিএইচডি গবেষণা শেষ করেন। এ এমন এক সময়, যখন অণুজীববিজ্ঞান, প্রাণরসায়নে যুগান্তকারী সব কাজ হচ্ছে। নতুন নতুন বিশ্লেষনী যন্ত্র নতুন সব দুয়ার খুলে দিচ্ছে। এর আগে জীববিজ্ঞানের প্রক্রিয়াগুলোর রাসায়নিক ব্যাপার স্যাপার বিশ্লেষণ করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ ছিলো, তাই প্রতিদিনই তখন নতুন সব তথ্য আসছে। জৈবিক প্রক্রিয়ার নানা অণু নিয়ে কাজ হলেও গ্লাইকেন নিয়ে খুব কমই কাজ হচ্ছিলো।

গ্লাইকেন নিয়ে একটু বলা যাক। গ্লাইকেন এক ধরনের পলিমার। অনেকগুলো স্যাকারাইড অণু মিলে তৈরি হয় গ্লাইকেন। একটা স্যাকারাইডের উদহারণ হলো আমরা যে চিনি খাই তা। নানা ধরনের গ্লাইকেন আছে। জীবদেহে বহু প্রক্রিয়ায় গ্লাইকেনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোষপ্রাচীরেও গ্লাইকেন আছে। কোন ভাইরাস দ্বারা শরীর আক্রান্ত হলে গ্লাইকেনের দরকার পরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু হতে। সে হিসেবে গ্লাইকেন নিয়ে প্রচুর গবেষণা হওয়ার কথা। কিন্তু কাজটা খুবই চ্যালেঞ্জিং, তাই গবেষণাও হচ্ছিলো খুবই কম। অল্প কিছু গবেষকের একজন ছিলেন এবারের রসায়নের নোবেলজয়ী ক্যারোলিন বারতোজ্জি।

বারতোজ্জি অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফলতা ছিলো সামান্যই। এমনই সময়ে তিনি এক কনফারেন্সে একটা গবেষণা দেখলেন, যেখানে জার্মান গবেষক দেখিয়েছেন, কীভাবে তিনি অপ্রাকৃতিক সিয়ালিক এসিড জীবকোষের মধ্যে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। তখন বারতোজ্জি ভাবলেন, তিনি যদি এই প্রক্রিয়ায় এমন সিয়ালিক এসিড তৈরি করতে পারেন যেখানে একটা রাসায়নিক হ্যান্ডল দেওয়া থাকবে, যা গিয়ে গ্লাইকেনের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করবে। এরপর সহজেই গ্লাইকেনকে ট্র্যাক করা যাবে। হ্যান্ডল থাকলে লাভ? কিছু হ্যান্ডেল অণু বা গ্রুপ আছে যেগুলো নির্দিষ্ট আলোর উপস্থিতিতে জ্বলজ্বল করে। এমন কোনো হ্যান্ডেল যদি যুক্ত করে দেওয়া যায়,মাইক্রোস্কোপের নিচে তা সহজেই চিহ্নিত করে গ্লাইকেনের চলাচল অনুসরণ করা যাবে।

এরপর লম্বা সময় বারতোজ্জি চেষ্টা করেছেন, এমন হ্যান্ডেল কীভাবে যুক্ত করা যায়। কাজটা সহজ নয়, এমন কোন হ্যান্ডেল যুক্ত করতে হবে, এবং যুক্ত করার প্রক্রিয়াও এমন হতে হবে যাতে কোষের জৈবিক প্রক্রিয়া কোনভাবে ব্যহত না হয়। তাহলে গবেষণার মূল উদ্দেশ্যই সফল হবে না, গ্লাইকেনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যাবে না।

১৯৯৭ সালে বারতোজ্জি দেখালেন, এই পদ্ধতি কাজ করবে। তখনও তিনি সমাধান খুঁজে পান নাই। ২০০০ সালে তিনি খুজে পেলেন একটা যুতসই হ্যান্ডেল, অ্যাজাইড। এজাইডের সঙ্গে একটা ফ্লুরেসেন্ট অণু, যা নির্দিষ্ট আলোর উপস্থিতিতে জ্বলজ্বল করবে যুক্ত করে দিলেই হবে। অ্যাজাইড জৈব প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে না, তাই একদম যোগ্য প্রার্থী।

এর কিছুদিন পরেই শার্পলেস আর মেলডেলের আবিষ্কার। শার্পলেস এবং মেলডেলের আবিষ্কার তখন তারকাখ্যাতি পেয়েছে রসায়নবিদদের মধ্যে। বারতোজ্জির কানেও ক্লিক রসায়নের খবর পৌছে গেছে। বারতোজ্জি দেখলেন, সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কারণ ক্লিক রসায়নের এই চমৎকার পদ্ধতি ব্যবহার করতে চাই কপার আয়ন। জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্য কপার আয়ন বিষাক্ত। একজন খাঁটি গবেষক হিসেবে বারতোজ্জি পুরানো পেপার ঘাটতে শুরু করলেন। একসময় তিনি পেয়েও গেলেন সমাধান।

১৯৬১ সালে প্রকাশিত গবেষনায় দেখা গেছে, অ্যালকাইন অ্যাজাইডের সঙ্গে খুব সহজেই বিক্রিয়া করে যদি অ্যালকাইনকে কোন একটা রিং বা চক্রের অংশ করা যায়, তাহলে যে অতিরিক্ত টান (strain) তৈরি হয়, তাতে অ্যালকাইন-অ্যাজাইড বিক্রিয়া করে ট্রায়াজল উৎপন্ন করে। বারতোজ্জি সফল হলেন, কোষের মধ্যেই ট্রায়াজলের মাধ্যমে গ্লাইকেনের সঙ্গে হ্যান্ডেল যুক্ত করা গেলো। এই প্রক্রিয়ার গালভরা নাম হলো স্ট্রেইন-প্রোমোটেড অ্যালকাইন-অ্যাজাইড সাইক্লোঅ্যাডিশন।

বারতোজ্জির প্রক্রিয়ার একটা উদহারণ দেওয়া যাক। বারতোজ্জি এমন একটা সুগার অণুর সঙ্গে অ্যাজাইড যুক্ত করলেন, যেটা গ্লাইকেন তৈরিতে কাজে লাগে। এরপর ওই অ্যাজাইডযুক্ত সুগার কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। কোষের মধ্যে যখন গ্লাইকেন তৈরি হলো, সেগুলোতে এক মাথায় একটা করে অ্যাজাইড আছে। এবার আরেকটা চক্রাকার অ্যালকাইনের এক মাথায় যুক্ত করলেন ফ্লুরেসেন্ট কোনো অণু, যা নির্দিষ্ট আলোতে জ্বলজ্বল করবে। এবার এই চক্রাকার অ্যালকাইন কোষের পরিবেশে ইনজেক্ট করলে তা সহজেই অ্যাজাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে যুক্ত হয়ে যাবে ট্রায়াজল হিসেবে। এরপর নির্দিষ্ট আলো ফেলে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে গ্লাইকেনের চলাচল পর্যবেক্ষণ করা যাবে। প্রক্রিয়াটা বিস্তারিত বুঝতে ওপরের ছবি দেখুন।

বারতোজ্জির গবেষণা নতুন জগত খুলে দিল। জীবদেহের মধ্যেই কোনো ধরনের জৈবিক প্রক্রিয়াকে ব্যহত না করে বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক বিক্রিয়া করার উপায় খুঁজে পেলেন। বারতোজ্জি এর সুন্দর এক নাম দিলেন, বায়োঅর্থোগোনাল রসায়ন।

বারতোজ্জির গবেষণাতেই দেখা গেল, কিছু গ্লাইকেন টিউমার কোষকে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) থেকে সুরক্ষা দেয়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা টিউমার কোষের কিছু করতে পারে না। এই জ্ঞান ব্যবহার করে বারতোজ্জি এবং তাঁর সহগবেষকরা গ্লাইকেনকে ভাঙতে পারে, এমন অ্যান্টিবডি তৈরি করেছেন, যা নতুন ধরনের ওষুধ তৈরিতে সহায়তা করেছে। অনেক গবেষক আরও ক্লিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করেছেন যেখানে একটা অণু প্রবেশ করানো হয় যা টিউমারের গ্লাইকেনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর আরেকটা ক্লিক অণু প্রবেশ করানো হয়, যেটা আবার ওই অ্যান্টিবডির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

অনেক গবেষক এই প্রক্রিয়ায় তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ ক্যানসার কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছেন। এরপর ক্যানসার কোষকে বাইরে থেকেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে তেজষ্ক্রিয়তা মেপে। বা এমন তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ প্রবেশ করানো হচ্ছে যা দিয়ে হয়ত ক্যানসার কোষটাই ধ্বংস করা যাবে।

ক্লিক রসায়ন আর বায়োঅর্থোগোনাল রসায়ন নিয়ে বিপুল পরিমাণ গবেষণা হচ্ছে। আশা করাই যায়, এই পদ্ধতি মানুষের জন্য কল্যাণকর নানা ওষুধ আবিষ্কারে সহায়তা করবে।

নোট: লেখাটি তৈরিতে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের প্রদত্ত রসায়নে নোবেল পুরষ্কার বিষয়ক জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক তথ্য ও বৈজ্ঞানিক পটভূমির প্রবন্ধ দুটি বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রসায়ন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: নোবেল ডট কম, নেচার ডট কম, শার্পলেস ও মেলডেলের প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ, এনআইএইচ ডট গভ