রসায়নের শত গল্প
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পেছনের রসায়ন
প্রকৃতির সবখানেই রসায়ন। আমাদের দেহের কথাই বলি বা চারপাশ ঘিরে থাকা বাতাস, ফুলের ঘ্রাণ—সবকিছুতেই আছে রসায়ন। এর মূল কথাগুলো কি সহজে জানা সম্ভব? মহাবিশ্বের মতো বিপুল রসায়নের জগতের মূল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় তুলে আনার সেই চেষ্টা করেছেন লেভ ভ্লাসভ ও দ্মিত্রিই ত্রিফোনভ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে সরাসরি রুশ থেকে, রসায়নের শত গল্প নামে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোয় ছিল প্রগতি প্রকাশন। সেখান থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। অনুবাদ করেন দ্বিজেন শর্মা। অঙ্গসজ্জা করেছেন লেওনিদ লাম। ক্লাসিক এই বই এতদিন পরও প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।
১৯১৩ সালে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সংবাদ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশালাকার যাত্রীবাহী জাহাজ ‘টাইটানিক’ হিমশৈলের আঘাতে ডুবে যায়। বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনার সম্ভাব্য বহু কারণ দেখান। বলা হয়, কুয়াশার জন্য ক্যাপ্টেন বিশাল হিমশৈলটি যথাসময়ে দেখতে পাননি, তাই সংঘর্ষ ও জাহাজডুবি।
কিন্তু এই করুণ ঘটনাটিকে রসায়নবিদদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা এক অভাবিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাব। পানির আরেক খেয়ালিপনার জন্যই ‘টাইটানিক’ জাহাজের বিপর্যয়।
বরফের তৈরি বিশাল, ভয়ঙ্কর, পর্বতসদৃশ এই হিমশৈল। ওজন হাজার হাজার টন নিয়েও এরা শোলার মতো পানিতে ভাসে। আর বরফ পানির চেয়ে হালকা বলেই তা সম্ভব।
কোনো ধাতু গলিয়ে এতে সেই ধাতুর কঠিন এক টুকরো ফেলে দেখুন: মুহূর্তে তা তলিয়ে যাবে। কঠিন অবস্থায় যেকোনো পদার্থের ঘনাঙ্ক তার তরল অবস্থার চেয়ে বেশি। অথচ বরফ ও পানি এ নিয়মের বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। কিন্তু ব্যতিক্রমটির ব্যত্যয় ঘটলে কী হতো? মধ্য অক্ষাংশের জলরাশির সবটুকুই তলা অবধি শীতে জমে যেত আর মারা পড়ত ওখানকার সবকটি জীবজন্তু ও শৈবালের দল। মনে করুন রুশ কবি নেক্সাসভের ছত্র:
হিমেল নদীর নরম তুষার,
ছড়ানো যেন গলন্ত চিনি
প্রবল হিম এলেই বরফ শক্ত হয়। নদীর বুক চিরে হাঁটাপথ চলে যায়। অথচ বরফের ঘন আস্তরের নীচে তখনো পানি থাকে, নদী বয়ে চলে নিরবধি। নদীতল অবধি কখনোই বরফ পৌঁছায় না।
বরফ, পানির এই কঠিন অবস্থাটি এক অদ্ভুত পদার্থ বটে। এটি কয়েক রকম। প্রকৃতিজাত বরফ গলে শূন্য ডিগ্রিতে। উচ্চচাপ ব্যবহারক্রমে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে আরও ছয় ধরনের বরফ তৈরি করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়করটি (৭ নম্বরটি) জমে স্বাভাবিক চাপমাত্রার ২১ হাজার ৭০০ গুণ বেশি চাপে। একে বলা যায় পরিতপ্ত বরফ। তা গলে স্বাভাবিক চাপমাত্রার ৩২ হাজার গুণ বেশি চাপে, শূন্যের ওপর ১৯২ ডিগ্রিতে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বরফ গলার দৃশ্যটি কত পরিচিত। অথচ এতে বিস্ময়ের কত চমকই না আছে!
যেকোনো কঠিন পদার্থই গলার পর প্রসারিত হয়। কিন্তু গলানো পানির আচরণ একেবারে আলাদা। এর সঙ্কোচন ঘটে এবং পরে তাপমাত্রা চড়লেই কেবল তার সম্প্রসারণ শুরু হয়। পানির অণুদের পারস্পরিক আকর্ষণের প্রবণতাই এর কারণ। শূন্যের ওপর চার ডিগ্রি তাপে এই প্রবণতাটি প্রকটতম হয়ে ওঠে, আর সেই তাপমাত্রায়ই পানির ঘনাঙ্ক সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলে এ দেশের নদী, পুকুর আর হ্রদগুলো শীতলতম আবহাওয়ায়ও তলা অবধি জমে যায় না।
আসন্ন বসন্তের আভাস সর্বত্র খুশির আমেজ ছড়ায়। সোনালী শরৎও আনন্দেই কেটেছিল। উচ্ছল বাসন্তী ঢল আর বনানীর রক্তিমাভা...
আবারও পানির সেই ব্যতিক্রমী ধর্ম! সমপরিমাণ অন্য যেকোনো পদার্থ অপেক্ষা বরফ গলাতে তাপের প্রয়োজন অনেক বেশি।
বরফ জমাট বাঁধার সময় তাপোদ্গিরণ ঘটে, প্রতিদানে বরফ আর তুষার মাটি ও বাতাসকে উত্তাপ দেয়। এরাই দূরন্ত শীতের হঠাৎ আসা আটকে রাখে শরতের কয়েক সপ্তাহ আয়ুর পরিসরে। আর বসন্তে ঘটে ঠিক এর উল্টোটি। গলা বরফ গুমোট আবহাওয়া ধরে রাখে কিছুদিন।
চলবে…