সাক্ষাৎকার

'আনন্দের জন্য হলেও বিজ্ঞান পড়া উচিত'—রউফুল আলম, রসায়নবিজ্ঞানী

রউফুল আলম বাংলাদেশি রসায়নবিজ্ঞানী। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। কাজ করছেন মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান পিটিসি থেরাপিউটিকসে। নতুন ড্রাগ উদ্ভাবন ও অণু তৈরির কাজ করেন। তাঁর স্বপ্ন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানশিক্ষা নিয়ে কাজ করবেন ভবিষ্যতে। সম্প্রতি বিজ্ঞানচিন্তাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে এই বিজ্ঞানীর বিদেশযাত্রা, গবেষণা, ভবিষ্যৎ স্বপ্নসহ আরও অনেক কিছু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার, সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ ও সম্পাদনা দলের সদস্য কাজী আকাশ

বিজ্ঞানচিন্তা:

শুরুতে জানতে চাই, কেমন আছেন?

রউফুল আলম: ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?

বিজ্ঞানচিন্তা:

আমরাও ভালো আছি। আপনি বর্তমানে কী নিয়ে কাজ করছেন, তা যদি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের উপযোগী করে বলেন।

রউফুল আলম: আমার কাজ জৈব রসায়ন নিয়ে। অর্গানিক কেমিস্ট বা জৈব রসায়নবিদকে আমি সহজভাবে বলি ‘অণুর মিস্ত্রি’। কোনো কাঠের মিস্ত্রির কাছে গেলে দেখবেন, মিস্ত্রি নানা সাইজ বা আকৃতির কাঠ নেবে। একটা কাঠের সঙ্গে আরেকটা আকৃতির কাঠ জোড়া দিয়ে ফার্নিচার বা একটা কাঠামো তৈরি করবে। জৈব রসায়নবিদের কাজ অনেকটা এ রকম। অণু ভেঙে নতুন অণু তৈরি করাই আমার কাজ।

বিজ্ঞানচিন্তা:

নতুন অণু বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

রউফুল আলম: আমরা নতুন অণু তৈরি করার আগে ডিজাইন করি। কী ধরনের রাসায়নিক যৌগ তৈরি করতে হবে, তা জেনে সেভাবে ডিজাইন করতে হয়। এটাকে আমরা বলি রেট্রোসিনথেসিস। ল্যাবরেটরিতে ছোট ছোট অণুকে একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে বড় যৌগে পরিণত করি। তখন ভিন্ন ভিন্ন অণু তৈরি হয়। নতুন অণু তৈরি হয়।

আমরা অণু দেখতে পারি না। তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হব যে কাঠামোটি তৈরি করতে চেয়েছিলাম, এটা সেই কাঠামোই হয়েছে? এটা নিশ্চিত করতে অনেক টুলস ব্যবহার করতে হয়। এই টুলগুলোর সাহায্যে অ্যানালাইসিস (বিশ্লেষণ) করে অণুর গঠন নিশ্চিত করি। রাসায়নিক যৌগ তৈরির পরে এটার বায়োলজিক্যাল ভেল্যু এবং বিভিন্ন লিভিং বডিতে (জীবিত দেহে) কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে গবেষণা করি।

আমি এখন কাজ করি ড্রাগ ডিসকভারি টিমে। ড্রাগ ডিসকভারি একটা ক্রসফাংশনাল টিম। এ টিমে থাকেন জীববিজ্ঞানী, অণুজীববিজ্ঞানী, ফার্মাকোলজিস্ট, কেমিস্ট এবং অন্যান্য অনেক শাখায় পড়াশোনা ও গবেষণা করা মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বাবা ও ছেলের সঙ্গে বিজ্ঞানী রউফুল আলম
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি নিজে কী কী নতুন অণু তৈরি করেছেন?

রউফুল আলম: অনেক রাসায়নিক যৌগ তৈরি করেছি আমি। এগুলোর আসলে নির্দিষ্ট নাম হয় না। মানে আমরা নাম ঠিকই দিই, তবে সেটা সফটওয়্যারের সাহায্যে। একজন রসায়নবিদ তাঁর গবেষণার জীবনে অনেক নতুন অণু তৈরি করেন। ড্রাগ ডিসকভারি টিমে কাজ করতে গেলেও অনেক ইউনিক (অনন্য) যৌগ সিনথেসিস (সংশ্লেষণ) করতে হয়।

কোনো ওষুধ আবিষ্কারের প্রজেক্ট শুরুর জন্য প্রথম কাজ হলো একটা রোগ টার্গেট করা। সেই রোগ কেন হয়, মুড অব অ্যাকশন কী, তা বোঝার চেষ্টা করা। মূলত জীববিজ্ঞানীরা এ কাজগুলো করেন। তাঁরা আমাদের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে বলেন, যেগুলো টার্গেট করা যায়। কোন রোগের কত রোগী আছেন এবং ওষুধ আবিষ্কৃত হলে তা মানুষের জন্য কতটা কাজে লাগবে, তা নিয়ে ভাবি। এরপর রসায়নবিদেরা তাঁদের রাসায়নিক যৌগের লাইব্রেরি (সংগ্রহ) থেকে দেখার চেষ্টা করেন, এমন কোনো যৌগ আছে কি না, যেটা পজিটিভ রেজাল্ট (ইতিবাচক ফল) দেবে। এটাকে আমরা বলি হিট। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির যৌগ থেকে প্রাইমারি হিট পাওয়া যায় কি না, সেটা দেখা হয়। পাওয়া গেলে যে যৌগ হিট দেবে, তার কাঠামো নিয়ে এগোই। এরপর আমরা ভাবি, এটাকে কীভাবে মডিফাই করা যায়। কীভাবে আরও ভালো যৌগ তৈরি করা যায়। এই প্রক্রিয়াকে আমরা বলি হিট টু লিড। এভাবেই আমরা ধাপে ধাপে অনেক নতুন যৌগ তৈরি করি। কয়েক হাজার রাসায়নিক যৌগ থেকে হয়তো একটা যৌগ অবশেষে সফলভাবে ওষুধ হিসেবে অনুমোদন পায়।

একটা ওষুধ উদ্ভাবন (ড্রাগ ডিসকভারি) করতে সাধারণত ছয় থেকে সাত বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় লাগে। আমি আসলে নন-ক্লিনিক্যাল রিসার্চ করি। ওষুধ উদ্ভাবনকে যে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, তার একটি নন-ক্লিনিক্যাল এবং অন্যটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ। ওষুধ ফেজ ট্রায়াল বা হিউম্যান ট্রায়ালে গেলে সেটাকে ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বলে। আমার কাজ নন-ক্লিনিক্যাল রিসার্চ নিয়ে। অর্থাৎ যৌগ তৈরি করে নানা প্রাণীর ওপর তা প্রয়োগ করে নিরাপত্তা (Safety) নিয়ে গবেষণা করতে হয়। দেখতে হয়, ওই ওষুধের নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা আছে কি না। এরপর সেই ওষুধ প্রয়োগ করা হয় মানুষের ওপর। ড্রাগ ডিসকভারি গবেষণার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো, নিরাপদ অণু খুঁজে পাওয়া। এ জন্য কোনো শর্টকাট বা সহজ পথ নেই। ট্রায়াল অ্যান্ড এররের (বারবার ভুল করে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া) মধ্য দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আপনার শৈশব–কৈশোর সম্পর্কে বলুন। আপনার গ্রামের কথা শুনতে চাই।

রউফুল আলম: আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। গ্রামের স্কুলেই পড়েছি। কারণ, আমার আব্বা চাকরি করতেন চাঁদপুরে। তখন আমরা ওখানেই ছিলাম পরিবারের সঙ্গে। হঠাৎ আব্বা চাকরি ছেড়ে দিলে আমরা গ্রামে চলে আসি। আব্বা যদিও পরে অন্য জায়গায় একই ধরনের চাকরি করেছেন, কিন্তু তখন আমরা গ্রামে ছিলাম। সেই অর্থে আমার কৈশোর গ্রামে কেটেছে। ক্লাস সিক্স থেকে বা মাঝামাঝি সময় থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত গ্রামে কাটে। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। তারপর ভর্তি হই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে চলে যাই যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়াতে। এখন তো চাকরি করছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

হ্যাঁ, আপনি তো বর্তমানে পিটিসি থেরাপিউটিকসে আছেন।

রউফুল আলম: হ্যাঁ, পিটিসি থেরাপিউটিকস একটা ফার্মাসিউটিক্যালস অ্যান্ড বায়োটেক কোম্পানি। ওরা ড্রাগ ডিসকভারি নিয়ে কাজ করে।

বিজ্ঞানচিন্তা হাতে রউফুল আলম
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

এবার জানতে চাই, ছোটবেলায় কখনো ভেবেছিলেন আপনি বিজ্ঞানী হবেন?

রউফুল আলম: স্কুলে থাকতে কখনো ভাবিনি। কিন্তু কলেজে গিয়ে বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট নিজেই করেছিলাম। সত্যি বলতে, তখনো ভাবিনি বিজ্ঞানী হব। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে এই এক্সপেরিমেন্টগুলো করে আমি আনন্দ পাই। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় আমাদের খুব ছোট্ট একটা বাসা ছিল। সেই বাসাতেই আমি রসায়ন বই দেখে বাজার থেকে টেস্টটিউব, বার্নার—এগুলো কিনে এনেছিলাম। বাড়িতেই ডিটারজেন্ট থেকে সোডিয়াম কার্বনেট তৈরি করেছিলাম। সোডিয়াম কার্বনেট হয়েছিল কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য লিটমাস পেপার ব্যবহার করি। তখন অবশ্য আমার কাছে লিটমাস পেপার ছিল না। কিন্তু বইয়ে পড়েছিলাম, জবা ফুলের পাপড়ি দিয়ে এ পরীক্ষা করা যায়। তখন জবা ফুলের পাপড়ি দিয়েই পরীক্ষাটা করি। জানি না, কতটুকু বিশুদ্ধ সোডিয়াম কার্বনেট তৈরি করতে পেরেছিলাম। মনে আছে, কোনো সতর্কতা অবলম্বন করিনি। তাই ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থকে অল্পের জন্য রক্ষা পাই। টেস্টটিউব থেকে পার্টিকেল লাফ দিয়ে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছিল।

এ ঘটনার পর থেকে আমি বায়োলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট শুরু করি। কারণ, তাতে ঝুঁকি কম। প্রথমে বাড়িতেই একটা ওয়াক্স-ট্রে বানিয়েছিলাম। আমাদের কলেজের বোটানি ল্যাব অনেক সমৃদ্ধ ছিল। ল্যাবে দেখতাম, অনেক গাছ সংরক্ষণে রাখা আছে। একদিন ল্যাবের ডেমোনেস্ট্রেটরকে জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন, এটা উদ্ভিদকে ফরমালিনে সংরক্ষণ করে রাখে। তারপর আমি খুঁজতে লাগলাম ফরমালিন কোথায় কিনতে পাওয়া যায়। একদিন ড্রাগের স্টোরে পেয়ে গেলাম। তখন ফরমালিনে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ করতে শুরু করি। আমার মনে আছে, ধুতরাগাছ সংরক্ষণ করেছিলাম। কারণ, এ গাছ সব জায়গায় পাওয়া যেত না। কিন্তু ফরমালিনের মাপে গরমিল হওয়ায় সব গাছ নষ্ট হয়ে যেত। ফরমালিনের কিন্তু উটকো গন্ধ আছে। এই উটকো গন্ধের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য একদিন মা আমাকে না জানিয়ে সব ফরমালিনের পাত্র ফেলে দেন। এর মাধ্যমে আমার বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের সমাপ্তি ঘটে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা আছে? 

রউফুল আলম: বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়ালেখা রসায়ন নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে আমি গবেষণার দিকে আকৃষ্ট হই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়ের কারণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলি।

মাস্টার্সের জন্য সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পর সেখানে দেখলাম উন্নত বিশ্বে কীভাবে গবেষণা হয়। তখন আবার গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হই। আসলে স্টকহোম ইউনিভার্সিটি এমন একটি জায়গা, যেটা আপনাকে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় বিজ্ঞানী আসতেন বক্তব্য দিতে। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি, যেখান থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, সেটা আমার ক্যাম্পাস থেকে খুব কাছে ছিল। গুজব ছিল, আমাদের ক্যাম্পাসে যাঁরা বক্তব্য দিতে আসতেন, তাঁরা কয়েক বছরের মধ্যে নোবেল পাবেন। যখন স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করি, তখন আমার স্বপ্ন ছিল, আমিও একদিন নোবেল পাব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি মাস্টার্স করতে সুইডেনে যান ২০০৯ সালে। তখন বাংলাদেশ থেকে খুব কম শিক্ষার্থী ন্যাচারাল সায়েন্স পড়তে সুইডেনে যেতেন। সে সময় আপনি কেন সুইডেনে যাওয়ার চিন্তা করলেন? 

রউফুল আলম: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের যেসব স্কলারশিপ দেওয়া হয়, আমি তার সব কটিতে আবেদন করি। এর মধ্যে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ স্কলারশিপও ছিল। পাশাপাশি আমি আরও খুঁজতে লাগলাম, ইউরোপের কোথায় পড়তে টিউশন ফি লাগে না। তখন আমি স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আবার রসায়ন প্রোগ্রামেও আবেদন করি। আমার দুটিতেই পড়ার সুযোগ হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

রসায়ন বিষয় অনেক শিক্ষার্থী পছন্দ করেন না। সেখানে আপনি রসায়নে অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি ও পোস্টডক করেছেন। রসায়নের প্রতি আপনার এত আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে? 

রউফুল আলম: মনের অজান্তে রসায়নের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। কলেজে থাকাকালে খুব জেনেবুঝে এক্সপেরিমেন্টগুলো করিনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে রসায়ন থাকায় রসায়ন নিয়েই পড়ার চিন্তা করি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমানে রসায়ন নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। আপনার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে রসায়ন নিয়ে হওয়া কিছু ভালো গবেষণার কথা বলুন।

রউফুল আলম: রসায়নের ক্ষেত্র অনেক বড়। এর শাখাও অনেক। সব ক্ষেত্র সম্পর্কে আমার একার পক্ষে বলা কঠিন। তাই আমি শুধু জৈব রসায়ন নিয়ে বলি। সম্প্রতি জৈব রসায়নে অনেক বড় ও যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে রসায়নে নোবেল পেলেন যাঁরা, তাঁদের ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য। প্যালেডিয়াম ক্যাটালাইজড বিক্রিয়া নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন। এটা যে কত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, তা আমরা দেশে বসে অনুভব করতে পারি না। আসলে আমরা যারা মেডিসিনাল কেমিস্ট, তারা প্রত্যেকে প্যালেডিয়াম ক্যাটালাইজড বিক্রিয়া করে থাকি। এটা মূলত নতুন রাসায়নিক বন্ধন তৈরির বিক্রিয়া। জৈব রসায়নের ক্ষেত্রে একটা নতুন বন্ধন তৈরির বিক্রিয়া কত সহজে উদ্ভাবন করা যায়, সেটাই হলো আসল। সুজুকি বিক্রিয়া (Suzuki Reaction) ঠিক তেমন একটি বিক্রিয়া। এ বিক্রিয়ার মাধ্যমে খুব সহজে দুটি ছোট অণুকে জোড়া লাগানো যায়। এ বিক্রিয়াকে কাপলিং বিক্রিয়াও বলা হয়। কিন্তু এই কাজ করতে প্যালেডিয়াম ধাতুর সাহায্য লাগে। জৈব রসায়নে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল।

সম্প্রতি অ্যাসিমেট্রিক ক্যাটালাইসিস বিক্রিয়ার জন্য প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান ও জার্মানির অধ্যাপক বেনজামিন লিস্ট নোবেল পেলেন। বায়োলজিক্যাল কিছু কম্পাউন্ড (যৌগ) আছে, যেগুলো ব্যবহার করলে অনেক দিক থেকে আমরা উপকৃত হই। ট্রানজিশন ধাতুগুলো আমরা যখন ব্যবহার করি, ব্যবহারের পরে এগুলো সামান্য পরিমাণে যদি ড্রাগ মলিকিউলের সঙ্গে থেকে যায়, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ও অন্যান্য জীবের জন্য তা ক্ষতিকর হবে। তাই ওখানে ট্রানজিশন মেটাল বা অবস্থান্তর ধাতু ব্যবহার না করে কোনো বায়োলজিক্যাল কম্পাউন্ড ব্যবহার করা গেলে ভালো। সে ক্ষেত্রে সামান্য পদার্থ যদি থেকেও যায়, তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হবে। ওই দুই বিজ্ঞানী চিন্তা করলেন, ট্রানজিশন মেটাল ব্যবহার না করে, ক্যাটালিস্ট হিসেবে জৈব যৌগ বা বায়োলজিক্যাল কম্পাউন্ড ব্যবহার করে অনেক নতুন বিক্রিয়া করা হয়তো সম্ভব। ওই যৌগগুলোকে প্রভাবক হিসেবে ব্যবহার করে কীভাবে বিক্রিয়া করা যায়, সেটাই তাঁরা দেখালেন। এটা খুব নতুন কোনো ধারণা নয়। তাঁরা মূলত ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এখানে একটি বিষয় বলা যায়। অ্যাসিমেট্রিক যৌগ হলে যেসব রাসায়নিক যৌগের মধ্যে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য থাকে না; সেগুলোকে আমরা অ্যাসিমেট্রিক যৌগ বলি। এ ধরনের কম্পাউন্ড কিন্তু প্রকৃতিতে অনেক আছে। আমাদের শরীরের সব প্রোটিন অ্যাসিমেট্রিক যৌগ। একটি অ্যাসিমেট্রিক যৌগ যখন অন্য অ্যাসিমেট্রিক যৌগের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তখন ঠিকভাবে কম্বিনেশন না হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অ্যাসিমেট্রিক কম্পাউন্ড তৈরির জন্য একটি অ্যাসিমেট্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হয়, যেটা আমরা ক্যাটালিস্টের মাধ্যমে দিতে পারি। জৈব রসায়নে এ ধরনের ক্যাটালাইসিস বা অনুঘটন বিক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ বিক্রিয়ার মূলকথা হলো, একটি বিক্রিয়াকে কীভাবে দ্রুত ও কার্যকরভাবে করা যায়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি এখন ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। সে ক্ষেত্রে কি আপনাদের কোনো বিশেষ ধরনের বিক্রিয়া নিয়ে নিয়মিত কাজ করতে হয়?

রউফুল আলম: হ্যাঁ। প্রতিনিয়তই আমরা বিভিন্ন বিক্রিয়া প্রয়োগ করি গবেষণাগারে যেমন আমাদের প্রতিনিয়ত সুজুকি বিক্রিয়া করতে হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) খুব জনপ্রিয়। আপনাদের ফিল্ডে কি এর কোনো প্রভাব রয়েছে?

রউফুল আলম: হ্যাঁ, আমাদের ফিল্ডে এর প্রভাব অনেক বেশি। কারণ, আমরা যে নতুন কম্পাউন্ড তৈরি করি, তার সব তথ্য আমাদের পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ডেটা অ্যানালাইসিস করে কোনো কম্পাউন্ডের বৈশিষ্ট্য জানার জন্য আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি অবসরে কী করেন? 

রউফুল আলম: বেশির ভাগ সময় ছেলের সঙ্গে কাটাই। তা ছাড়া লেখালেখিও করি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার প্রিয় বইগুলো সম্পর্কে বলুন।

রউফুল আলম: আমি অনেক বই পড়েছি। সে হিসেবে সাহিত্যের বইগুলো আমার পছন্দের। এখন বেশি ডকুমেন্টারি দেখা হয়। বিবিসির প্রায় সব ডকুমেন্টারি দেখেছি। সম্প্রতি মহাকাশ নিয়ে লেখার জন্য স্টিফেন হকিংয়ের বইগুলো পড়া হয়েছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার প্রিয় একটা বইয়ের নাম বলুন, যা আপনার মতে সবার পড়া উচিত। 

রউফুল আলম: আমার মতে কার্ল সাগানের কসমস বইটি সবার পড়া উচিত। আর স্টিফেন হকিংয়ের আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইটিও।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ফিকশনের মধ্যে আপনার প্রিয় বইগুলো কী কী?

রউফুল আলম: হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প এবং দেয়াল। আনিসুল হকের মা উপন্যাসটি আমার খুব প্রিয়। এ ছাড়া সূর্য–দীঘল বাড়ি গল্পটি আমাকে নাড়া দিয়েছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার প্রিয় লেখক কারা? 

রউফুল আলম: স্টিফেন হকিংয়ের কথা বলা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আনিসুল হক আছেন। তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা জরুরি। আমরা যারা গবেষণার সঙ্গে জড়িত, তারা খুব বেশি বাইরের বই পড়ার সুযোগ পাই না। কারণ, আমাদের যে পরিমাণ সায়েন্টিফিক আর্টিকেল পড়তে হয়, তারপর সময় বের করা খুব কঠিন।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে? দেশে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে?

রউফুল আলম: দেশে ফেরার বিষয়ে আমি এখন বলতে পারছি না। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। বিশেষ করে গ্রামের বিজ্ঞানশিক্ষার দিকটি। গ্রামে বিজ্ঞানশিক্ষা খুব দুর্বল। তাই সেটা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশের কোনো শিক্ষার্থী যদি বিদেশে যেতে চায়, সে ক্ষেত্রে তার স্কুল বা কলেজ লেভেলে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?

রউফুল আলম: কেউ যদি স্নাতক পড়ার জন্য যেতে চায়, সে ক্ষেত্রে কলেজ থেকে প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। আমাদের দেশে যে বিভিন্ন অলিম্পিয়াড হয়, সেগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নেওয়া। এ ছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোতে অংশ নেওয়া। পাশাপাশি ভাষাগত যোগ্যতা অর্জনের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

রউফুল আলম: আমার মতে, বিজ্ঞানচিন্তা সবার পড়া উচিত। বিজ্ঞান এমন একটি জিনিস, যা আমরা হয়তো সব সময় উপলব্ধি করি না, কিন্তু প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি। আমাদের বসবাস বিজ্ঞান নিয়েই। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবলে, কীভাবে সেগুলো কাজ করে, তা নিয়ে চিন্তা করলে বিজ্ঞান শেখার আনন্দ পাব আমরা। তাই আমি মনে করি, আনন্দের জন্য হলেও তরুণদের বিজ্ঞান পড়া উচিত।

অনুলিখন: সাবরিনা আনোয়ার, শিক্ষার্থী, সিটি কলেজ, ঢাকা