যেভাবে পেলাম আমেরিসিয়াম শব্দটি

নতুন কিছু আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এসব নামের পেছনেও লুকিয়ে থাকে মজার ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশগুলো জড়িয়ে পড়েছে সে যুদ্ধে। এ যুদ্ধের কারণে তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে তখন গবেষণা তুঙ্গে। যুদ্ধ শুরুর আগেই কোনো পরমাণুর কেন্দ্রে নিউট্রন ছুড়ে, তা বিভাজিত করে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরুর পদ্ধতি শিখে যান বিজ্ঞানীরা। আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভরশক্তি সমীকরণ অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ শক্তি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান-জাপান বাহিনীকে টেক্কা দিতে অচিরেই পারমাণবিক বোমা বানাতে গোপনে ম্যানহাটান প্রজেক্ট শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এরই অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী ৬০ ইঞ্চি সাইক্লোটন ব্যবহার করে নতুন নতুন তেজস্ক্রিয় মৌলের জন্ম দিচ্ছিলেন। মার্কিন রসায়নবিদ গ্লেন সিবর্গের নেতৃত্বে ১৯৪৪ সালে এমনই এক পরীক্ষায় প্লুটোনিয়াম পরমাণুর কেন্দ্র লক্ষ্য করে ছোড়া হলো একের পর এক নিউট্রন কণা। কিছু পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অতিরিক্ত নিউট্রন যুক্ত হলো। এরপর সেগুলো ক্ষয় হয়ে প্রোটনে রূপান্তরিত হয়। তাতে ওই অস্থিতিশীল পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা ৯৪ থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৯৫। অ্যাকটেনাইড সিরিজের নতুন এই কৃত্রিম মৌলটির নাম দেওয়া হলো আমেরিসিয়াম। এ নাম দেওয়ার কারণ হলো, পর্যায় সারণিতে ল্যান্থানাইড সিরিজে এই মৌলের ঠিক ওপরেই আছে ৬৩ নম্বর মৌল, যার নাম ইউরোপিয়াম। এর নাম রাখা হয়েছিল ইউরোপ মহাদেশের কথা মাথায় রেখে। তার সঙ্গে মিল রেখে তাই ৯৫ পারমাণবিক সংখ্যার মৌলটির নাম রাখা হলো আমেরিকা মহাদেশের নামানুসারে। অর্থাৎ আমেরিসিয়াম।

মজার ব্যাপার হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে মৌলটি আবিষ্কৃত হলেও তা প্রায় এক বছর গোপন রাখা হয়েছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, নিরাপত্তার স্বার্থে। যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো দেশ এই তেজস্ক্রিয় মৌলের কথা জেনে না যায়, সে জন্যই এমন রাখঢাক। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের ১১ নভেম্বরে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির এক মিটিংয়ে এ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে বলে ঠিক করা হয়। কিন্তু তার মাত্র পাঁচ দিন আগে শিশুদের জন্য সম্প্রচারিত একটা রেডিও শোতে অংশ নেন রসায়নবিদ গ্লেন সিবর্গ। এক শ্রোতা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, যুদ্ধের সময়ে প্লুটোনিয়াম আর নেপচুনিয়ামের পর আর নতুন কোনো মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে কি না। উত্তরে একটু ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত তথ্যটা ফাঁস করে দেন সিবর্গ।

এ মৌলের সংকেত Am। আমেরিসিয়ামের ১৯টি আইসোটোপ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতটা হলো Am-২৪১ এবং Am-২৪৩। এগুলোর অর্ধায়ু যথাক্রমে ৪৩২.২ বছর এবং ৭ হাজার ৩৭০ বছর। বর্তমানে বাসাবাড়ির স্মোক ডিটেক্টরে সামান্য পরিমাণ আমেরিসিয়াম ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতের নভোযানের নিউক্লিয়ার জ্বালানি হিসেবেও এর ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে।