মণি-মুক্তার মৌল : বেরিলিয়াম

মণি-মুক্তা মানুষকে হাজার হাজার বছর ধরে মোহিত করে রেখেছে। সবুজ, লাল বা হালকা নীলাভ স্বচ্ছ সব পাথরে মানুষ যেমন আভিজাত্য খুঁজেছে, তেমনি বিশ্বাস করতে চেয়েছে, একটি মুক্তা ফিরিয়ে দিতে পারে জীবনের গতিপথ। ভাগ্যের সঙ্গে মণি-মুক্তার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সৌন্দর্যের কিন্তু কমতি হয়নি এখনো। এই যে মণি-মুক্তা, এর মূল উপাদান একটি স্বচ্ছ খনিজ, সাধারণ নাম বেরিল। রসায়নবিদদের কাছে পরিচিত বেরিলিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সাইক্লোসিলিকেট নামে, যার মধ্যে খুব অল্প পরিমাণে থাকে ক্রোমিয়াম বা ভ্যানাডিয়াম। এর জন্যই সৃষ্টি হয় মোহনীয় সব রং। বেরিলের স্বচ্ছ রং থেকেই উত্পন্ন হয়েছে জার্মান শব্দ ব্রাইল, বাংলায় চশমা।

মজার ব্যাপার হলো, বেরিলিয়াম লবণের স্বাদ মিষ্টি। এ কারণে ১৭৯৮ সালে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী লুই নিকোলা ভ্যাকুলিন যখন বেরিল থেকে বেরিলিয়াম লবণ আলাদা করেন, এর নাম রাখেন গ্লুসিনিয়াম, মিষ্টি গ্লুকোজের সঙ্গে মিল রেখে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৭ সালে বেরিলিয়াম নামটাই টিকে যায়, গৃহীত হয় সব ভাষায়।

প্রকৃতিতে কোটি কোটি বছর ধরেই আছে বেরিলিয়ামের অস্তিত্ব। কিন্তু প্রথম বেরিলিয়াম মৌল আলাদা করা সম্ভব হয় ১৮২৮ সালে। একই সময় আলাদাভাবে ফ্রিডরিখ ভোলার ও অ্যান্তনি বাসি বেরিলিয়াম ক্লোরাইডকে বিক্রিয়া করান পটাশিয়ামের সঙ্গে। উত্পাদ হিসেবে তাঁরা পান বিশুদ্ধ বেরিলিয়াম মৌল। ১৮৯৮ সালে পল লেবিউ বেরিলিয়াম ফ্লোরাইড আর সোডিয়াম ফ্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে উত্পন্ন করেন বেরিলিয়াম মৌল। বর্তমানে বেরিলিয়াম উত্পাদনে অবশ্য ব্যবহৃত হয় ম্যাগনেশিয়াম ও বেরিলিয়াম ফ্লোরাইডের জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া।

পর্যায় সারণিতে বেরিলিয়াম চতুর্থ মৌল। হিসাবমতো এটি ধাতু হিসেবে দ্বিতীয়ও। তবে আকৃতির দিক দিয়ে বেরিলিয়াম সবচেয়ে ছোট ধাতু। এমনকি এর চেয়ে হালকা ধাতু লিথিয়াম থেকেও। বেরিলিয়ামও লিথিয়াম বা সোডিয়ামের মতো সক্রিয় ধাতু। সোডিয়ামকে যদিও উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা যায় না, রাখতে হয় কেরোসিন তেলে ডুবিয়ে। কিন্তু বেরিলিয়ামকে অনায়াসেই রেখে দেওয়া যায় উন্মুক্ত পরিবেশে। কারণ, বাতাসে রাখলে খুব দ্রুত বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বেরিলিয়াম অক্সাইডের একটা পাতলা আবরণ তৈরি হয়, যা আরও বিক্রিয়া করতে বাধা দেয়।

তাই দেখা যায়, শক্তিশালী অ্যাসিডের মধ্যেও বেরিলিয়াম বিক্রিয়া করে না। যদিও কম ঘনমাত্রার হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে ঠিকই বিক্রিয়া করে বেরিলিয়াম, তখন উত্পন্ন হয় হাইড্রোজেন গ্যাস। বেরিলিয়ামের গলনাঙ্ক অনেক বেশি, ১,২৮৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর স্থিতিস্থাপকতা বা ইলাস্টিসিটিও অনেক বেশি, উচ্চশক্তির নিউট্রনকে বিচ্ছুরণ করতে পারে। এসব কারণে বেরিলিয়াম ব্যবহৃত হয় নানা কাজে।

বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় এক্স-রে তৈরি করা হয় এক্স-রে টিউবে। এক্স-রে টিউবের জানালা (উইন্ডো) হিসেবে ব্যবহৃত হয় বেরিলিয়াম। কারণ, এক্স-রের কাছে বেরিলিয়াম একদম স্বচ্ছ। বলা যায়, বেরিলিয়ামের মধ্য দিয়ে এক্স-রে কোনো রকম বাধাই পায় না। উচ্চশক্তির কণার কাছে বেরিলিয়ামের এই স্বচ্ছতার জন্য সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের ডিটেক্টরের একটি উপাদান বেরিলিয়াম। এর বাইরে সব ধরনের নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতিতেই বেরিলিয়ামের ব্যবহার রয়েছে। যেমন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বা নিউক্লিয়ার বোমার নিউট্রন প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহৃত হয় বেরিলিয়াম।

প্রাকৃতিক নিউক্লীয় বিক্রিয়ায়ও বেরিলিয়ামের অবদান অপরিসীম। যেমন ধরা যাক কার্বনের কথা। পৃথিবীর সব প্রাণ কার্বননির্ভর। সে কার্বন যে নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় তৈরি হয়, তার বিক্রিয়ক বেরিলিয়াম। কোনো তারার বয়স অনেক বেশি হলে ট্রিপল আলফা প্রসেস ঘটে। এ সময় তিনটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস (আলফা কণা) যুক্ত হয়ে কার্বন-১২ তৈরি করে। প্রথম পর্যায়ে দুটো আলফা কণা মিলে একটা বেরিলিয়াম-৮ নিউক্লিয়াস তৈরি করে। বেরিলিয়াম-৮ খুবই অস্থিতিশীল একটা মৌল। তাই খুব দ্রুত তা ভেঙে দুটো আলফা কণায় পরিণত হয়। কিন্তু বিশেষ অবস্থায় বেরিলিয়াম ভাঙার হার গড়ার হারের চেয়ে কম হয়। তখন অল্প পরিমাণ বেরিলিয়াম আরেকটা আলফা কণা যুক্ত করে কার্বন-১২ পরমাণু তৈরি করে ফেলে, যা যথেষ্ট স্থিতিশীল। আমাদের সূর্য এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে আরও প্রায় ৬০০ কোটি বছর পর।

বেরিলিয়ামের সংকর ধাতুর মেকানিক্যাল, তাপীয় ও তড়িৎ ধর্ম একে বিশেষ করে তোলে। যেমন বেরিলিয়াম-কপার সংকর ধাতু অচৌম্বক ধর্ম দেখায়। তাই তা ব্যবহার করা যায় জাইরোস্কোপ ও এমআরআই মেশিনে। অপর দিকে বেরিলিয়াম খুব কম তাপমাত্রায়ও সব ধর্ম বজায় রেখে টিকে থাকতে পারে, যা কাচ পারে না। তাই মহাকাশে বা সেনাবাহিনীর যন্ত্রপাতিতে বেরিলিয়াম ব্যবহৃত হয়।

আধুনিক প্রযুক্তি পুরোপুরি নির্ভরশীল ইলেকট্রনিকের ওপর। আর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হয় ভেজালমিশ্রিত সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী দিয়ে। এই ভেজাল মেশানোর কাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তির নাম মলিকুলার বিম এপিট্যাক্সি, যার জন্য প্রয়োজন হয় বেরিলিয়াম।

সাধারণত কোনো পদার্থ তড়িৎ অপরিবাহী হলে তাপ কুপরিবাহী হয়। কিন্তু বেরিলিয়াম অক্সাইড তড়িৎ অপরিবাহী হলেও চমত্কার তাপ পরিবাহী। এ জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যবহার সম্ভব বেরিলিয়াম অক্সাইডের। তবে এটাই সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যবহার নয়। বেরিলিয়াম আয়ন সম্ভবত কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রসেসর হিসেবে ব্যবহার করা যাবে সফলতার সঙ্গে। এমন একটি কম্পিউটার ইতিমধ্যে বানানো হয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ সময় এই প্রসেসর ঠিকমতো কাজ করেছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, ভবিষ্যতে বেরিলিয়ামনির্ভর প্রসেসর তৈরি হতে যাচ্ছে।

এত এত ব্যবহার থাকলেও বেরিলিয়াম কিন্তু খুবই বিষাক্ত পদার্থ। বেরিলিয়াম লবণ মিষ্টি। তবে তা ক্ষতিকর হওয়ায় কখনো মিষ্ট স্বাদের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। অন্য কোনো উপায়ে ব্যবহার করতে গিয়েও বেরিলিয়াম কোনোভাবে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে, বিশেষ করে বেরিলিয়ামের ধুলা। নিশ্বাসের সঙ্গে তা শরীরে প্রবেশ করলে বেরিলিওসিস নামক ফুসফুসের এক ক্রনিক রোগ হতে পারে। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এ রোগ ধরা পড়তে মাসের পর মাস, এমনকি বছর লেগে যেতে পারে। এর কোনো চিকিত্সাও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এর মানে এই নয় যে বেরিলিয়াম ব্যবহার করা যাবে না। এর মানে হলো বেরিলিয়াম সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।

বেরিলিয়ামের সব ধর্ম এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, গবেষণা চলছে। তবে এখন পরীক্ষাগারে গবেষণার চেয়ে বেরিলিয়াম নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণাই হচ্ছে বেশি। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ধর্মের কারণেই বেরিলিয়াম যে ভবিষ্যতে দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। সম্ভাবনা আছে, একসময়ের মণি-মুক্তার মৌল, এক রকম মূল্যবান হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো অতি আধুনিক প্রযুক্তিতেও।

সূত্র: নেচার কেমিস্ট্রিতে রালফ পুশতার লেখা অবলম্বনে