এককালে পরশ পাথরের খোঁজে নেমেছিল একদল মানুষ। তাদের ধারণা ছিল, এমন একটা বস্তু বানানো সম্ভব, যার ছোঁয়ায় যেকোনো ধাতুকে (বিশেষ করে সিসার মতো কম দামের ধাতুকে) স্বর্ণে রূপান্তর করা যাবে। একেই বলা হয় পরশ পাথর বা ফিলোসফার্স স্টোন। সেজন্য নানা ধরনের তুকতাক, জাদুবিদ্যাসহ নানা অপবিদ্যার চর্চা চলত সেকালে। এসব মানুষদের বলা হতো অ্যালকেমিস্ট। আর তাদের গুপ্ত এই বিদ্যাকে বলা হতো অ্যালকেমি। বাংলায় বলা হয় অপরসায়ন।
প্রাচীনকাল থেকে মিশর, পারস্য, ভারত থেকে শুরু করে মধ্যযুগে আরব বিশ্ব এবং শেষকালে ইউরোপেও এ বিদ্যার চর্চা অব্যহত ছিল। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা কোনোকালেই সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিশ শতকের শুরুর দিকে ব্যাপারটা সম্ভব বলে প্রমাণ করেন পদার্থবিজ্ঞানীরা।
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটার উত্তরে হ্যাঁ বলতে হয়। মানে, অন্য মৌল থেকে স্বর্ণ তৈরি করা সম্ভব। তবে সেজন্য পরশ পাথরের দরকার নেই। তার বদলে দরকার নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক।
যেকোনো মৌলের পরমাণুতে সাধারণত তিনটি কণা থাকে। সেই উপপারমাণবিক কণাগুলো হলো প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রন। কম-বেশি সবারই জানা আছে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। আর এই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘোরে ইলেকট্রন কণা। আরও সঠিকভাবে বললে, নিউক্লিয়াসের চারপাশে থাকে ইলেকট্রনের মেঘ (ইলেকট্রন ক্লাউড)। বেশিরভাগ পরমাণুর ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারিত হয় তার প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যার ওপর। কোন পরমাণুতে কয়টি ইলেকট্রন থাকবে, তা নির্ভর করে এর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা কতটি তার ওপর। প্রোটন সংখ্যা পরমাণুর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক করে দেয়। প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট প্রোটন সংখ্যার পরমাণু সাধারণত একই আচরণ করে (কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়; যেমন, আইসোটোপ)। সে কারণেই নিউক্লিয়াসে একই সংখ্যক প্রোটন থাকা পরমাণুকে আমরা বলি রাসায়নিক মৌল বা কেমিক্যাল এলিমেন্ট।
সোনা বা স্বর্ণও এরকম একটি মৌল। এর প্রতিটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসে মোট ৭৯টি প্রোটন থাকে। কাজেই অন্য কোনো মৌলের পরমাণুতে প্রোটন সংখ্যা যদি ৭৯টি করা সম্ভব হয়, তাহলে পরমাণুটি স্বর্ণে রূপান্তরিত হবে। যেমন প্লাটিনামের পরমাণুতে থাকে ৭৮টি প্রোটন। অন্যদিকে পারদের পরমাণুতে প্রোটন থাকে ৮০টি। এখন প্লাটিনামের নিউক্লিয়াসে যদি একটি প্রোটন যোগ করা যায় কিংবা পারদের পরমাণু থেকে একটা প্রোটন যদি হটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পরমাণুটি স্বর্ণে পরিণত হবে।
প্রশ্ন জাগবে, সেটি কীভাবে করা সম্ভব?
এর উত্তরটা আগেই সংক্ষেপে দিয়েছি—পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে। অর্থাৎ পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটন যোগ বা বিয়োগ করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তাত্ত্বিকভাবে ব্যাপারটা পানির মতো সহজ বলে মনে হবে, কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা বেশ জটিল ও কঠিন।
এই প্রক্রিয়ায় স্বর্ণের মতো দামী ধাতু বানানো হয় না কেন? তাহলে তো পৃথিবীতে স্বর্ণের অভাব থাকত না!
সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর ইলেকট্রন সংখ্যা বাড়তে বা কমতে পারে। কিন্তু এ বিক্রিয়ায় পরমাণুর প্রোটন সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না। সে কারণেই প্রাচীন কালে অ্যালকেমিস্টদের সীসাকে স্বর্ণে রূপান্তর করার স্বপ্ন কোনোদিন সফল হয়নি। রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো তুলনামূলক সহজ। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার জন্য অনেক শক্তির প্রয়োজন। তার কারণ হলো, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনগুলো খুবই দৃঢ়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে আটকে থাকে। তাই নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটন বের করে আনতে বা যোগ করতে অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন। আধুনিক বিজ্ঞান সেটাও সম্ভব করেছে। সেটা করা যায় পরমাণু চুল্লিতে তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে, অথবা পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরের নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে পারমাণবিক কণার গুলি ছুড়তে হয়। ১৯৪১ সালে পারদের নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে তিনজন বিজ্ঞানী নিউট্রন কণা ছুড়ে স্বর্ণ বানিয়েছিলেন।
পারদ ও প্লাটিনাম মৌল থেকে সাধারণত গবেষণাগারে স্বর্ণ বানানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় পারদ (৮০টি প্রোটন) বা প্লাটিনামের (৭৮টি প্রোটন) নিউক্লিয়াসে সজোরে নিউট্রন কণা ছুড়ে দেওয়া হয়। এভাবে ওই দুই মৌলের নিউক্লিয়াস থেকে একটা নিউট্রন যোগ হতে পারে কিংবা একটা নিউট্রন নিউক্লিয়াস থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতেও পারে। যোগ হওয়া নিউট্রনটা তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ায় একসময় প্রোটনে পরিণত হয়। এভাবে প্লাটিনামে একটি প্রোটন যুক্ত হয়ে প্রোটন সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৯টি। অর্থাৎ প্লাটিনাম পরিণত হয় স্বর্ণে। আবার পারদের নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে নিউট্রন ছুড়লেও নিউক্লিয়াসটা অস্থিতিশীল ও তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেটাই ক্ষয় হয়ে স্বর্ণে পরিণত হয়।
তাহলে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে—এই প্রক্রিয়ায় স্বর্ণের মতো দামী ধাতু বানানো হয় না কেন? তাহলে তো পৃথিবীতে স্বর্ণের অভাব থাকত না! তাহলে স্বর্ণের প্রতি মানুষের লোভও থেমে যেত!
সেটা না করার পেছনে কারণও আছে যথেষ্ট। প্রথমত, পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল ও কঠিন, তা আগেই বলেছি। পাশাপাশি এর খরচও অনেক বেশি, এমনকি সাধারণ স্বর্ণের চেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, এভাবে পাওয়া স্বর্ণ তেজস্ক্রিয় হয়, যা মানুষের জন্য বিপদজনক। তাই এ প্রক্রিয়ায় পাওয়া স্বর্ণ বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয় না। তাছাড়া তেজস্ক্রিয় হওয়ার কারণে এই স্বর্ণ কদিন পর ক্ষয় হয়ে অন্য মৌলে পরিণত হয়। মানে পুরোটাই আসলে লস প্রজেক্ট।