হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন: প্রফুল্লচন্দ্রের অনন্য আবিষ্কার

বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস। শহরের পূর্ব প্রান্তে আদিগন্ত জলাভূমি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের শিক্ষক, এডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। এই কারখানার পেছনে রয়েছে অদম্য মানুষটির সারা জীবনের উপার্জন ও জ্ঞানভান্ডার।

১৯১৪ সাল। ইউরোপের মাটিতে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ২৮ জুন ১৯১৪, গ্যাভ্রিলো প্রিন্সেপ নামের বসনিয়ান অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের এক উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে সারায়েভোতে খুন করল। ঘটনাক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে উঠতে ঘনিয়ে এল যুদ্ধের কালো ছায়া। বলকান অঞ্চলের দুটি দেশের মধ্যে সংঘর্ষে ইউরোপের মহাশক্তিধর দেশগুলোর জড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না একটুও। শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরির পক্ষে জার্মানি ও ইতালি। অন্যপক্ষে ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেন। এই যুদ্ধ ছিল তখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বোচ্চ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ব্রিস্টল, ফকার, সিমেন্স, হ্যান্ডলি, গোথা নামের যুদ্ধবিমানগুলো থেকে ফেলা বোমার দৌলতে মৃত ও আহত মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল হু হু করে। এর সঙ্গে বুলেট, মাইন, কামান, ট্যাংকের গোলায় মৃত্যু তো আছেই। রণাঙ্গনে যাঁদের মৃত্যু হলো, তাঁরা না হয় মুক্তি পেয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল লাখ লাখ আহত সৈনিক ও সাধারণ মানুষ। বোমার আঘাতে ঝলসে যাওয়া মানুষে ভরে উঠল হাসপাতালের পর হাসপাতাল। মৃত্যুযন্ত্রণা, আর্তনাদে বিদীর্ণ হয়ে গেল আকাশ–বাতাস। ধুঁকে ধুঁকে মরতে লাগল অগুনতি দগ্ধ মানুষ। এভাবে শক্তিক্ষয় ব্রিটেনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। খোঁজ পড়ল এমন কোনো ওষুধ আছে কি না, যা মানুষগুলোর যন্ত্রণা লাঘব করতে পারে, সারিয়ে তুলতে পারে, ফিরিয়ে দিতে পারে স্বাভাবিক জীবন। মনে রাখতে হবে, তখনো পৃথিবী অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটাই শোনেনি।

খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ওষুধ মিলল। মিলল ব্রিটিশের গর্বের উপনিবেশ, লন্ডন অব দ্য ইস্ট, তথা কলকাতার এক ওষুধ উৎপাদক কারখানায়। নাম তার বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস। শহরের পূর্ব প্রান্তে আদিগন্ত জলাভূমি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের শিক্ষক, এডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। এই কারখানার পেছনে রয়েছে অদম্য মানুষটির সারা জীবনের উপার্জন ও জ্ঞানভান্ডার।

প্রথমে নিজের বাড়িতেই বসিয়েছিলেন কারখানা। একা হাতে তৈরি করতেন ওষুধ। সঙ্গী ছিল একমাত্র পরিচারক গফুর। নিজের তৈরি ওষুধ বিক্রি করতে ঝোলায় ওষুধ ভরে ঘুরেছেন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়। কেউ পাত্তা দেয়নি। বিলেতি ওষুধ ছেড়ে বিলেতফেরত অধ্যাপকের ওষুধ রাখতে রাজি হয়নি কোনো ওষুধের দোকান (কীভাবে বেঙ্গল কেমিক্যাল জনপ্রিয় হলো, সে গল্প অন্য কোনো দিন বলা যাবে)।

এই সংগ্রামে অবশ্য তিনি পাশে পেয়েছিলেন কিছু শিক্ষিত উদারমনা নিঃস্বার্থ বাঙালিকে, যেমন কলকাতা মেট্রোপলিটন কলেজে (এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ) তাঁর সহপাঠী এবং এমবি ডিগ্রিধারী চিকিৎসক অমূল্যচরণ বোস এবং তাঁর ভগ্নিপতি, ১৮৯০ সালে রসায়নে এমএ পাস সতীশচন্দ্র সিংহ। তাঁদের যোগদানে বেঙ্গল কেমিক্যাল দ্রুতগতিতে ব্যবসা বাড়াতে লাগল। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটল অনর্থপাত।

সতীশচন্দ্র একদিন কাজ করছিলেন হাইড্রোজেন সায়ানাইড নিয়ে। অসাবধানে সায়ানাইড-সংক্রমিত গ্লাসে জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রফুল্লচন্দ্র বেরিয়েছিলেন বৈকালিক ভ্রমণে। ফিরে এসে চিকিৎসক ডাকলেন। নিয়ে গেলেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু সতীশচন্দ্রকে বাঁচানো গেল না (১৮৯৪)। আচার্য চোখে অন্ধকার দেখলেন।

এ ঘটনার কিছুদিন পর ঘনিয়ে এল আরেক বিপদ। বিউবোনিক প্লেগের রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারালেন অমূল্যচরণ। এরপর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় পাশে পেয়েছিলেন কলকাতার আরেক স্বনামধন্য চিকিৎসক আমহার্স্ট স্ট্রিটের কার্তিকচন্দ্র বোসকে। তখন উত্তর কলকাতার পূর্ব প্রান্তে মানিকতলায় বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সবে গড়ে উঠছে। কিন্তু কলকাতা শহর থেকে সেখানে যাওয়ার কোনো ভালো রাস্তা নেই। চিকিৎসক বোসের মাথায় এক বুদ্ধি খেলল। তিনি কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারদের বললেন মানিকতলা মোড় থেকে তাঁরা যদি বেঙ্গল কেমিক্যালের দিকে ময়লা ফেলতে ফেলতে যান, তবে তিনি বিনা মূল্যে তাঁদের চিকিৎসা করবেন। তাঁদের ফেলা ময়লা জমাট বেঁধেই জলাভূমির ওপর তৈরি হলো রাস্তা, যাকে আজ আমরা বলি মানিকতলা মেইন রোড। এ রকম অজস্র ইতিহাস পাথেয় করে বেড়ে উঠেছিল বাঙালির গর্বের প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যাল।

১৯০২ সালে এই কারখানায় যোগ দেন তরুণ রসায়নবিদ স্বনামধন্য রাজশেখর বসু। এক বছরের মধ্যেই কারখানার ম্যানেজার। প্রফুল্লচন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। হাসিমুখ, প্রীতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তিনিই বানালেন পোড়ার এক অব্যর্থ ওষুধ। কতিলা আঠার (Tragacanth mucilage) সঙ্গে ট্যানিক অ্যাসিডের মিশ্রণ।

কতিলা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিল এই দেশে। রাজশেখর নতুন ওষুধের নামকরণ নিজেই করলেন—ট্যানোলেপ। বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রায় সব উৎপাদনের নাম, প্যাকেজিং, বিজ্ঞাপন নিজ হাতে করতেন রাজশেখর। সঙ্গী ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু চিত্রশিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেন ওরফে নারদ। পরবর্তীকালে রাজশেখর বসু, অর্থাৎ পরশুরামের অধিকাংশ গল্প এবং বইয়ের অলংকরণ করেছিলেন নারদ। ট্যানোলেপ লাগালে ফোসকা পড়ে না। ফলে ঝলসানো রোগীর ট্রমাও অনেক কম হয়। তদানীন্তন ইংরেজ সরকার বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকার ট্যানোলেপ কিনেছিল। সংখ্যাটা খেয়াল করবেন—৬,০০,০০০। অনুমান করুন কত লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিল এই ওষুধ। বলা চলে ট্যানোলেপের সাফল্যের কারণেই আচার্য রায়কে ১৯১৯ সালে নাইটহুড উপাধি দিয়ে সম্মান জানায় ব্রিটিশ সরকার।

পরিশেষে বলব, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ বাঙালি নবজাগরণের দূতের উত্তরাধিকারী ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র বা রাজশেখরের মতো মানুষেরা। কুসংস্কার ও ধর্মের কারা ভেঙে কীভাবে তাঁরা নিজেদের যুক্ত করেছিলেন বিশ্বজনীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্রোতে, সে এক অসম্ভব ‘সুন্দর’ গল্প, যা প্রত্যেক বাঙালির জানা উচিত। এটাও জানা দরকার যে আমরা আজ সেই চর্চায় পিছিয়ে পড়েছি কেন? তাঁদের উত্তরাধিকার আমরা বহন করতে পারিনি কেন? কীভাবে পরাজিত হলেন এই মহানায়কেরা? সে এক অসম্ভব ‘যন্ত্রণার’ গল্প। সে গল্প আদ্যন্ত রাজনৈতিক। সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলে বিজ্ঞানচর্চা যে নিম্নগামী হয়, এটা তারই উদাহরণ।

আজ করোনার দৌলতে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং বেঙ্গল কেমিক্যাল নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে। তাই ইতিহাসকে ফিরে দেখার চেষ্টা। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন দেশ–বিদেশের অসংখ্য বিজ্ঞানী। তাঁদের সম্মান জানিয়েই রইল এই সামান্য প্রতিবেদন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস, কলকাতা, ভারত