পৃথিবীর সবচেয়ে ঘাতসহ পদার্থ

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত পদার্থ কী? প্রশ্নটা শুনে অনেকের মুখেই বোধ হয় উত্তর চলে এসেছে—হীরে! আসলেই, হীরে দারুণ শক্ত এক পদার্থ। আমরা জানি, পৃথিবীর বয়স সাড়ে ৪০০ কোটি বছরের মতো। আর হীরে তৈরি হওয়া শুরু হতেই সময় লাগে ১০০ থেকে ৩৩০ কোটি বছর। এ ছাড়াও লাগে চাপ। প্রচণ্ড চাপ! সেই চাপের মান প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৮ লাখ ২৫ হাজার পাউণ্ড। বোঝার সুবিধার্থে কেজিতে যদি বলি হিসেবটা, সংখ্যাটা হবে ৩ লাখ ৭৪ হাজার কেজিরও বেশি। মানে, প্রতি ইঞ্চি জায়গার ওপর এতটা ভর দিয়ে চাপ দিতে হবে। শুধু চাপ দিলেই হবে না, তাপও দিতে হবে। প্রায় দেড় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ! কার্বনকে এই পরিমাণ চাপ ও তাপের মধ্যে রাখলে সেটা হীরেতে পরিণত হতে শুরু করবে কেবল। এই জিনিস শক্ত হবে না, সে উপায় কই! শুধু শক্ত-ই নয়, কার্বন যথেষ্ট ঘাতসহ পদার্থ। সহজে একে ভাঙা বা কাটা যায় না।

হীরের চেয়ে আরও বেশি ঘাতসহ পদার্থ কার্বনেরই আরেকটি প্রতিরূপ। গ্রাফিন। গ্রাফিন আসলে এক ধরনের ন্যানোগঠন। কার্বনের পরমাণুকে এক স্তরে ষড়ভুজাকারে সজ্জিত করে এই বিন্যাস তৈরি করা হয়। গ্রাফিন কতটা ঘাতসহ, সেটা শুনে নেওয়া যাক একজন বিজ্ঞানীর মুখে।

মাইনাস ২৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের ‘হাই এনট্রপি’ সংকরের মাইক্রোস্কোপিক ছবি
এই পদার্থটির চাপ সহ্য করার ক্ষমতা প্রতি মিটারে ৪০০-৫০০ মেগাপ্যাসকেল! গ্রাফিনের চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ ঘাতসহ এই পদার্থটি আসলে ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের সংকর

যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বার্কলির ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক রবার্ট রিচি বলেন, ‘গ্রাফিন প্রতি মিটারে ৪ মেগাপ্যাসকেল চাপ নিতে পারে। আর উড়োযানে যে অ্যালুমিনিয়ামের সংকর ধাতু ব্যবহার করা হয়, তা প্রতি মিটারে চাপ নিতে পারে ৩৫ মেগাপ্যাসকেলের মতো।’ বলে রাখি, অবশ্য সবাই সম্ভবত জানেন, চাপের একক প্যাসকেল। ১ বর্গমিটার ক্ষেত্রের ওপর ১ নিউটন প্রযুক্ত বলের ফলে সৃষ্ট চাপের মান ১ প্যাসকেল। আর মেগাপ্যাসকেল মানে ১০ প্যাসকেল।

 এইটুকু পড়ে দ্বিধান্বিত হওয়ার কিছু নেই। আসলে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘাতসহ পদার্থের কথা বলিইনি এখনো! এই পদার্থটির চাপ সহ্য করার ক্ষমতা প্রতি মিটারে ৪০০-৫০০ মেগাপ্যাসকেল! গ্রাফিনের চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ ঘাতসহ এই পদার্থটি আসলে ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের সংকর।

এই সংকর ধাতুটির কথা বিজ্ঞানীরা আগেই জানতেন। জানতেন, এটি দারুণ ঘাতসহ। কিন্তু কতটা ঘাতসহ, এ বিষয়ে তাঁদের সঠিক ধারণা ছিল না। গত ১ ডিসেম্বর সায়েন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা যায়, একদল বিজ্ঞানী এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শুরু করেন। তাঁরা এটিকে প্রচণ্ড শীতল পরিবেশে রেখে দেখতে চান, কতটা শীতল অবস্থায় এটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। কিন্তু গবেষণার ফলাফল দেখে তাঁদের চক্ষু, যাকে বলে, কপালে ওঠার জোগাড়!

ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের এই সংকর ধাতু আসলে এক ধরনের ‘হাই এনট্রপি’ সংকর। অন্যান্য সংকরের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। সাধারণত সংকরে একটি ধাতুর পরিমাণ থাকে অনেকটা বেশি। সঙ্গে অন্য ধাতুর সামান্য অংশ মেশানো হয়। কিন্তু ‘হাই এনট্রপি’ সংকরে সব ধাতু মেশানো থাকে সমান পরিমাণে। এক্ষেত্রে যেমন ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেল—৩টিই মেশানো হয়েছে সমান পরিমাণে।

ধাতুর বৈশিষ্ট্যই হলো, এটি ঘাতসহ ও নমনীয়। তবু একটা নির্দিষ্ট চাপের মুখে ভেঙে যেতে বাধ্য তো হয়ই। সংকরের ঘাতসহতা ও নমনীয়তা সে তুলনায় বেশি হয়। আর ‘হাই এনট্রপি’ সংকর প্রচণ্ড (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এক্সট্রিম’) ঘাতসহ ও নমনীয়। এর কারণ কী? আসলে, ধাতুর পরমাণুগুলোর মধ্যে যা হয়, পরমাণুর সব বিজোড় ইলেকট্রন মুক্ত হয়ে একসঙ্গে ইলেকট্রনসমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। আর আয়নিত ধাতব নিউক্লিয়াস জড়ো হয়ে থাকে একসঙ্গে, ডুবে থাকে সেই ইলেকট্রনসমুদ্রে। এসব নিউক্লিয়াস বা ধাতব আয়ন (পড়ুন, আয়নিত নিউক্লিয়াস) প্রয়োজনে একে অন্যের থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলেও ভেঙে যায় না ধাতববন্ধন। এটিই ধাতুর ঘাতসহতা ও নমনীয়তার কারণ। সংকরের ক্ষেত্রে যেহেতু একাধিক ধাতু একসঙ্গে মিশে থাকে, তাই তাদের এই বন্ধন হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী। কারণ, আয়নিত নিউক্লিয়াসগুলো প্রয়োজনে একে অন্যের থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েও ডুবে থাকতে পারে ধাতব বন্ধনের মূল কারিগর মুক্ত ধাতব ইলেকট্রনের সমুদ্রে।

সংকরের ঘাতসহ হওয়ার বিষয়টি তো বোঝা গেল। এবার চক্ষু চড়ক গাছ হওয়া সেই এক্সপেরিমেন্টের কথা বলা যাক।

পর্যায় সারণিতে এখন ১১৯টি মৌল। এর মধ্যে ৫০টির মতো আমাদের নিত্যব্যবহার্য।

বিজ্ঞানীরা প্রথমে ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের এই সংকরকে মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়েছেন। লাভ হয়নি। ভাঙার বদলে ওটা আরও বেশি ঘাতসহ আচরণ করতে শুরু করেছে! বিজ্ঞানীরা এরপর ঠান্ডা মাথায় নতুন করে এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছেন। মাইনাস ২৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তরল হিলিয়ামে চুবিয়েছেন এই সংকর। তারপর ওর ওপর নিউট্রন ছুঁড়ে মেরে নিউট্রন বিক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করে দেখেছেন, ওতে ফাটল ধরছে কি না। মাইনাস ২৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস মানে, পরম শূন্যের প্রায় কাছাকাছি। এই তাপমাত্রায় গিয়ে এতে ফাটল ধরেছে। মানে, বলা যায় এই সংকর গ্রাফিনকে একরকম খেলনা প্রমাণ করে ছেড়েছে!

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই পদার্থ মহাশূন্যে পাঠানো নভোযান থেকে শুরু করে দৈনন্দিন বিভিন্ন যন্ত্রে কাজে লাগানো যাবে। এটি ব্যবহার করে বানানো যাবে হাইড্রোজেন সংরক্ষণাগার। ফলে হাইড্রোজেন জ্বালানী ব্যবহার করে চালানো যাবে পরিবেশবান্ধব গাড়ি।

সময় লাগবে অবশ্যই। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকর ব্যবহারের উপযোগিতার কথাও জানা যাচ্ছে এই গবেষণা থেকে। পর্যায় সারণিতে এখন ১১৯টি মৌল। এর মধ্যে ৫০টির মতো আমাদের নিত্যব্যবহার্য। আর এই সংকরটি হলো মাত্র ৩টি ধাতুর মিশ্রণ। তার মানে, ৫টি, ৭টি বা এরকম বেশ কয়টি ধাতুর মিশ্রণে হয়তো বানানো যাবে আরও অনেক বেশি ঘাতসহ পদার্থ।

দেখা যাক, বিজ্ঞানীরা কতটা এগোতে পারেন। দেখা যাক, পর্যায় সারণির এসব ধাতুর সংকর আর কী চমক রেখে দিয়েছে আমাদের জন্য। সম্ভাবনা অনেক। এই সম্ভাবনা আমাদের দারুণ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: লাইভসায়েন্স ডট কম