মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি যে মৌলটি পাওয়া যায়, তার নাম হাইড্রোজেন। গ্রিক শব্দ হাইড্রো এবং জিন থেকে হাইড্রোজেন শব্দের উৎপত্তি। হাইড্রো অর্থ পানি, আর জিন মানে উৎপাদক বা সৃষ্টিকারী। অর্থাৎ, হাইড্রোজেন শব্দের মানে পানি সৃষ্টিকারী। এটিই পর্যায় সারণির প্রথম মৌল। পারমাণবিক সংখ্যা ১। প্রতীক H। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর লস অ্যালোমস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির মতে, মহাবিশ্বে যত পরমাণু আছে, তার ৯০ শতাংশেরও বেশি হাইড্রোজেন। ভরের হিসেবে এটি মহাবিশ্বের মোট ভরের চার ভাগের এক ভাগ।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির মতে, হাইড্রোজেন জীবনের জন্য অপরিহার্য। প্রায় সব জীবিত বস্তুর মধ্যেই আছে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি। নক্ষত্রের মধ্যেও এ মৌলটির প্রভাব আছে। নক্ষত্রের ভেতরে প্রোটন-প্রোটন বিক্রিয়া ঘটে এবং কার্বন-নাইট্রোজেন চক্রের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদিত হয়। হাইড্রোজেনের ফিউশন বিক্রিয়ায় দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু জোড় বেঁধে হিলিয়াম গঠন করে। এ সময় মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর শক্তি।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন নেই। হাইড্রোজেন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যাকর্ষণের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে হারিয়ে যায়। আমাদের গ্রহে হাইড্রোজেন প্রধানত অক্সিজেন ও পানির পাশাপাশি জীবন্ত উদ্ভিদ, পেট্রোলিয়াম এবং কয়লার মতো জৈব পদার্থের সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়।
মানুষের পক্ষে প্রথম হাইড্রোজেন তৈরির রেকর্ড বহু পুরনো। ১৫ শতকের প্রথমার্ধে সুইডিশ বিজ্ঞানী থিওফ্রাসটাস প্যারাসেলসাস (Theophrastus Paracelsus) প্রথম হাইড্রোজেন আবিষ্কার করেন। তিনি সালফিউরিক এসিডের মধ্যে আয়রন বা লোহা দ্রবীভূত করে দেখেন, একটা গ্যাস বের হচ্ছে। এই পরীক্ষার পর তিনি বলেন, ‘দমকা হাওয়ার মতো বাতাস বেরিয়ে আসে।’ তবে তিনি হাইড্রোজেনের কোনো বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে পারেননি।
এরপর কেটে গেছে প্রায় দেড়শ বছর। হাইড্রোজেন নিয়ে আর কারও কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা এ সময়ের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ১৬৫০ সালে জেনেভার বিজ্ঞানী টারকুয়ে দে মেয়ার (Turquet De Mayerne) প্যারাসেলসাসের পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেন, হাইড্রোজেন দাহ্য।
প্যারাসেলসাস বা দে মেয়ার কেউই হাইড্রোজেনকে একটি নতুন মৌল বা উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেননি। আসলে প্যারাসেলসাস বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে মাত্র তিনটি উপাদান আছে। লবন, সালফার ও পারদ। এ ছাড়া অন্যান্য যে মৌল পাওয়া যায়, তার সবই এই তিন উপাদানের মিশ্রণের।
১৬৭১ সাল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল লোহার সঙ্গে অ্যাসিড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। তিনি দেখতে পান, হাইড্রোজেন শুধু বাতাসের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে। (বাতাস বলতে এখানে অক্সিজেনের কথা বলা হয়েছে)। তবে তিনিও একে মৌল হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হন।
গবেষকেরা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। এ প্রযুক্তির সাহায্যে হাইড্রোজেন গ্যাসকে দূষণমুক্ত শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করা হবে।
১৭৬৬ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসের হাত ধরে হাইড্রোজেন স্বতন্ত্র মৌল হিসাবে স্বীকৃতি পায়। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সঙ্গে জিঙ্ক বা দস্তার বিক্রিয়া করিয়ে হাইড্রোজেন আবিষ্কার করেন হেনরি। তিনি এটাও লক্ষ্য করেছিলেন যে হাইড্রোজেনকে পোড়ালে পানি উৎপাদন হয়।
১৭৮৩ সালে ফরাসি রসায়নবিদ অ্যান্টোনি ল্যাভয়সিয়ে (আসলে ওনার নাম, অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে) প্রথম হাইড্রোজেনের নামকরণ করেন। নামটি কীভাবে এলো, অর্থাৎ কোন শব্দ থেকে এলো তা ওপরে ইতিমধ্যে জানিয়েছি।
১৮০৬ সালের কথা। হাইড্রোজেন ততদিনে একটি স্বতন্ত্র মৌল হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। এরকম সময়ে ব্রিটিশ রসায়নবিদ হামফ্রে ডেভি বিশুদ্ধ পানির মধ্যে শক্তিশালী বিদ্যুৎ প্রবাহ চালালেন। দেখলেন, পানি থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন উৎপাদন হয়েছে। এ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায়, বিদ্যুৎ কোনো যৌগ থেকে মৌলকে আলাদা করতে পারে। ডেভি বুঝতে পেরেছিলেন, পদার্থগুলো একটি বৈদ্যুতিক কারণে একত্রে আবদ্ধ ছিল। তিনি রাসায়নিক বন্ধনের প্রকৃত রহস্য আবিষ্কার করেছিলেন।
হাইড্রোজেনের তিনটি সাধারণ আইসোটোপ আছে। প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। প্রোটিয়াম-ই সবচেয়ে প্রচলিত, সাধারণ হাইড্রোজেন। এর নিউক্লিয়াসে শুধু একটি প্রোটন আছে। ডিউটেরিয়াম একটি স্থিতিশীল আইসোটোপ। এর নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন আছে। ১৯৩২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিদ হ্যারল্ড ইউরি (Harold Urey) এটি আবিষ্কার করেন। ট্রিটিয়াম একটি অস্থিতিশীল আইসোটোপ। নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং অস্ট্রেলিয়ান দুই পদার্থবিদ মার্কাস লরেন্স (Sir Marcus Laurence Elwin Oliphant) ও পল কার্ল মারিয়া (Paul Karl Maria Harteck) ১৯৩৪ সালে ট্রিটিয়াম আবিষ্কার করেন। ট্রিটিয়ামের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন আছে। অর্থাৎ, হাইড্রোজেনের আইসোটোপগুলোর মধ্যে পার্থক্য শুধু নিউট্রনে। সেজন্যই এদের আইসোটোপ বলে (আইসোটোপ মানে সমপ্রোটিন বিশিষ্ট)। হাইড্রোজেনের (মানে প্রোটিয়ামের) নিজস্ব কোনো নিউট্রন না থাকলেও ডিউটেরিয়ামে একটি ও ট্রিটিয়ামে দুটি আছে। পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয় ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম।
হাইড্রোজেন অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিলে অনেকগুলো যৌগ তৈরি করতে পারে। যেমন পানি (H2O), অ্যামোনিয়া (NH3), মিথেন (CH4), চিনি (C12H22O11), হাইড্রোজেন পারক্সাইড (H2O2), হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCl) ইত্যাদি। অ্যামোনিয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন। নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন বিক্রিয়া করে সার উৎপাদন করে, কৃষকেরা এটি ব্যবহার করেন। হাইড্রোজেনের আরও নানা ধরনের ব্যবহার আছে। রকেটের জ্বালানি, ধাতব আকরিক হ্রাস করা কিংবা গ্যাস বেলুনও হাইড্রোজেন দিয়ে ফুলানো হয়। যদিও হাইড্রোজেন দিয়ে গ্যাস বেলুন ফোলানো উচিত নয়। যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
গবেষকেরা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। এ প্রযুক্তির সাহায্যে হাইড্রোজেন গ্যাসকে দূষণমুক্ত শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করা হবে। এই শক্তি গাড়ি বা অন্যান্য যানবাহনের জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যাবে।
তথ্য কণিকা:
১. বৃহস্পতি ও অন্যান্য দানব গ্যাসীয় গ্রহের প্রধান উপাদান হাইড্রোজেন।
২. মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মহাকাশে নভোচারী পাঠাতে রকেটের জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করেছিল হাইড্রোজেন।
৩. তরল হাইড্রোজেন অত্যন্ত ঠান্ডা এবং এটি ত্বকের সংস্পর্শে এলে মারাত্মক শীতল হতে পারে।
৪. হাইড্রোজেন বাতাসের চেয়ে প্রায় ১৪ গুণ হালকা।
৫. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট হাইড্রোজেন উৎপাদন করে।
৬. যে কোনো গ্যাসের তুলনায় হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘনত্ব সবচেয়ে কম।
৭. হাইড্রোজেন একমাত্র উপাদান যার তিনটি আইসোটোপ আছে।
৮. হাইড্রোজেন বর্ণহীন, গন্ধহীন এবং স্বাদহীন গ্যাস।
৯. হাইড্রোজেন একমাত্র পরমাণু যার জন্য শ্রোডিঙ্গার সমীকরণের সঠিক সমাধান আছে।
১০. জীবিত প্রাণীর ওজনের প্রায় ১০ শতাংশ হাইড্রোজেন।
১১. তরল হাইড্রোজেনের ঘনত্ব যেকোনো তরল পদার্থের চেয়ে কম।
১২. হাইড্রোজেন একমাত্র মৌল যার নিউট্রন নাই।
১৩. একমাত্র হাইড্রোজেনের অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
১৪. বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময় যে তিনটি উপাদান তৈরি হয়েছিল তার একটি হাইড্রোজেন। অন্য দুটি হিলিয়াম ও লিথিয়াম।
১৫. হাইড্রোজেন ধনাত্বক ও ঋণাত্বক দুই ধরণের আধানই গঠন করতে পারে।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: লাইভ সায়েন্স ডট কম, উইকিপিডিয়া, থটকো ডট কম ও কেমিকুল ডট কম