নিরাপদ চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যেসব ওষুধ মানুষ ব্যবহার করত, তার সব কটিই মূলত কোনো না কোনো উদ্ভিদ থেকে তৈরি। আফিম, মরফিন থেকে শুরু করে জীবন বাঁচানোর সব ধরনের উপাদান তৈরিতেই বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির ওপর এই নির্ভরশীলতা তাঁরা ধীরে ধীরে কমাতে চাইলেন। গবেষণাগারে কীভাবে উদ্ভিদ বা অন্য কোনো জীবিত প্রাণীর সাহায্য ছাড়া ওষুধ বানানো যায়, এ নিয়ে শুরু করলেন গবেষণা।

এ সময়ই বিজ্ঞানের যে শাখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী হিসেবে ধরা যায়, সেটি রসায়ন। সহজ ভাষায় রসায়ন বলতে আমরা বুঝি, কীভাবে পরমাণু একত্র হয়ে অণু গঠন করে এবং অণুগুলোর আচরণ কেমন হয়। কিন্তু তখনকার রসায়ন আজকের মতো এতটা আধুনিক ছিল না।

একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষ মনে করত, জীবিত প্রাণীর মধ্যে বিশেষ কোনো শক্তি আছে, যেটা কোনো জড় বা মৃত বস্তুর মধ্যে নেই। সেই শক্তির ফলেই জীবের বৃদ্ধি ঘটে, জড়ের ঘটে না। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অনেক বিজ্ঞানীও ভাবতেন, জীবিত প্রাণীর দেহে যে অণু বা পরমাণু পাওয়া যায়, সেগুলো জড় বস্তু থেকে পাওয়া, তা অণু বা পরমাণু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা তাঁদের এই তত্ত্বের পেছনে বেশ কিছু যুক্তিও দাঁড় করিয়েছিলেন। গবেষণাগারে যদি দুটি মৌলের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে নতুন আরেকটি যৌগ বানানো হয়, তাহলে সেই যৌগকে ভাঙলে আবার আগের মৌল দুটি ফিরে পাওয়া যায়। তখনকার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, প্রাণীর দেহে যেসব অণু বা পরমাণু থাকে, তারা এ নিয়ম মেনে চলে না। একটি ভাজা ডিমকে আবার নিশ্চয়ই আগের সাধারণ ডিমে রূপান্তর করা যাবে না! তা–ই না? এই ধারণা থেকে বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, জড় বস্তুতে আছে, এমন কোনো পরমাণু দিয়ে জীবদেহে বিদ্যমান কোনো অণু তৈরি করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এ ধারণা বেশি দিন টেকেনি। বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। এক দল বিশ্বাস করত, প্রাণীর দেহের পদার্থগুলো জড়বস্তুর মতো নয়, আলাদা। আরেক দল বিশ্বাস করত, প্রাণী হোক বা জড়—সবাই একই ধরনের পরমাণু দিয়ে তৈরি। আমরা এখন জানি, সবকিছুই—সেটা জীবিত হোক বা জড়, একই ধরনের পরমাণু দিয়ে তৈরি। এ ধারণা প্রমাণের প্রথম ধাপ শুরু করেন জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ ভোলার। নিজের গবেষণাগারে তিনি দুটি মৃত কোষ, অর্থাৎ জীবদেহের নয়, এমন দুটি কোষ দিয়ে ইউরিয়া প্রস্তুত করতে সক্ষম হন, যেটি জীবদেহে পাওয়া যায়। তাঁর হাত ধরেই মূলত আধুনিক জৈব রসায়নের সূচনা।

এর পরের কাজটি করেন ভোলারের বন্ধু জুস্টস ভন লেইবিগ, যাঁকে ভোলারের থেকেও বড় বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকে মনে করেন। একটি জীবের কোনো কোষের সঙ্গে জড়ের কোনো কোষ কীভাবে বিক্রিয়া করে, এ নিয়ে তিনি খুবই কৌতূহলী ছিলেন। নানা পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারও করে ফেলেন। তিনিই প্রথম লক্ষ করেন, কীভাবে বিভিন্ন খনিজ, যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি প্রয়োগের ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এককথায়, তিনি কৃষিকাজের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান ‘সার’ আবিষ্কার করে ফেলেন। এর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন যে জীবের গঠন, বেড়ে ওঠা ইত্যাদি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে হয়।

এ রকম নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সময় লেইবিগ অনেক অদ্ভুত জিনিস তৈরি করেছেন। এ রকম একটির নাম ক্লোরাল হাইড্রেট। ১৮৩২ সালে তিনি এটি প্রথম আবিষ্কার করেন। এর আগে এই যৌগ কোথাও ছিল না, কেউ তৈরিও করেননি, প্রকৃতিতেও এই যৌগের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। লেইবিগ যদিও তখন সেটা বুঝতে পারেননি। তিনি শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন। একসময় তিনি এই ক্লোরাল হাইড্রেটকে মিষ্টি গন্ধযুক্ত একধরনের তরলে পরিণত করেন এবং অবাক হয়ে দেখেন, এই তরলের বাষ্প দিয়ে সহজেই একজন মানুষকে অজ্ঞান করে ফেলা যায়! এভাবে নিজের অজান্তেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন মানুষকে সাময়িকভাবে অচেতন করার এক অব্যর্থ অস্ত্র—ক্লোরোফর্ম!

১৮৫০ সালের দিকে এসে অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা শুরু হয়। কিন্তু তখন এটি ব্যবহার করা ছিল খুবই কঠিন এবং বিপজ্জনক। কারণ, একটু বেশি পরিমাণ ক্লোরোফর্মের বাষ্প ভেতরে গেলে অপারেশন কক্ষেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ফলে গবেষকেরা এর পরিবর্তে আরেকটু নিরাপদ কিছু খুঁজতে লাগলেন। লেইবিগ আগেই ক্লোরোফর্মের তরল অবস্থা—ক্লোরাল হাইড্রেট গবেষণাগারে বানিয়ে দেখিয়েছেন। ফলে গবেষকেরা ক্লোরোফর্মের পরিবর্তে মানবদেহে ক্লোরাল হাইড্রেট ব্যবহার করা যায় কি না, সেটি পরীক্ষা করা শুরু করলেন।

ক্লোরাল হাইড্রেট কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন হলেও অ্যালকোহলের সঙ্গে মিশিয়ে সহজেই একে তরলে রূপান্তর করা যায়। তরল হোক বা কঠিন, ১৮৬০ নাগাদ প্রমাণিত হয়ে গেল, ক্লোরাল হাইড্রেট দিয়ে মানুষকে কিছু সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

আফিমের মতো প্রাকৃতিক ওষুধ দিয়ে হয়তো মানুষকে সহজেই কিছু সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন করা যায়, তবে এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু কৃত্রিমভাবে বানানো এই ক্লোরাল হাইড্রেট—তর্ক সাপেক্ষে যাকে ইতিহাসের প্রথম ঘুমের ওষুধ বলে ধরে নেওয়া হয়, এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। একটুখানি ক্লোরাল হাইড্রেট গ্রহণে মানুষ শান্ত হয়ে যাবে, আরেকটু গ্রহণ করলে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়বে এবং আরেকটু বেশি গ্রহণ করলে সরাসরি অচেতন।

তবে এত ভালো গুণের পাশাপাশি এই রাসায়নিকের কিছু অপব্যবহারও ইতিহাসে কম হয়নি। সেগুলো ব্যবহার করে বেশ কিছু অপরাধও সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। তবে সেগুলো জানাজানি হওয়ার পর অপরাধীরা শাস্তিও পেয়েছেন।

অপরাধের সঙ্গে নাম জড়িয়ে পড়লেও চিকিৎসায়, বিশেষ করে মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় ক্লোরাল হাইড্রেটের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ক্লোরাল হাইড্রেট আবিষ্কারের আগে মানসিক রোগীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাসপাতালের ওয়ার্ডেনরা শিকল ব্যবহার করতেন এবং তাদের শান্ত করার জন্য আফিম, মরফিন এমনকি গাঁজাও ব্যবহার করতেন। কিন্তু ক্লোরাল হাইড্রেট ব্যবহার করে খুব দ্রুত এবং সহজেই রোগীদের শান্ত করা যেত, তাই আবিষ্কারের পর থেকে শুধু এটিই ব্যবহার করতেন ওয়ার্ডেনরা।

ক্লোরাল হাইড্রেটের এই বহুল ব্যবহার চলে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত। রসায়নবিদেরা এর চেয়েও কার্যকর এবং নিরাপদ চেতনানাশক আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমতে থাকে। কিন্তু কমে গেলেও মাঝেমধ্যেই খবরের শিরোনাম হতে থাকে ক্লোরাল হাইড্রেট।

ক্লোরাল হাইড্রেটের ব্যবহার এখন শূন্যের কোঠায় হলেও এখনো গুরুত্বসহকারে উচ্চারিত হয় এর নাম। এ আবিষ্কারে বিজ্ঞানজগতে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ওষুধগুলোর চেয়ে শক্তিশালী ওষুধ বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে বানাতে পারেন। লেইবিগ এবং ভোলারের দেখানো পথে হেঁটে পরবর্তী বিজ্ঞানীরা আরও দারুণ সব ওষুধ ও রাসায়নিক আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানীরা তাই কৃতজ্ঞচিত্তে এ দুই বিজ্ঞানীর অবদান স্মরণ করেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: টমাস হ্যাগার/ টেন ড্রাগস