যেভাবে আবিষ্কৃত হলো ক্লোরোফর্ম

উইকিপিডিয়া

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ক্লোরোফর্মের সরাসরি ব্যবহার নেই। তবু ক্লোরোফর্ম সম্পর্কে প্রায় সবাই কমবেশি জানি। তার একটা বড় কারণ সম্ভবত সিনেমায় ক্লোরোফর্মের ব্যবহার। কাউকে আচমকা অজ্ঞান করতে এ রাসায়নিক দ্রব্যটি ব্যবহার করতে দেখা যায় সিনেমার নায়ক বা ভিলেনকে। তাতে লাগে মাত্র দুই-তিন সেকেন্ড। ব্যস, বেহুঁশ! কিন্তু বাস্তবে ক্লোরোফর্ম দিয়ে এত সহজে কাউকে অজ্ঞান করা সম্ভব নয়। সেজন্য ক্লোরোফর্ম নাক দিয়ে শুঁকতে হবে অন্তত একটানা ৭/৮ মিনিট।

এ বৈশিষ্ট্যের কারণে ক্লোরোফর্ম একসময় চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছিল। এককালে কোনো চেতনানাশক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করা হতো। রোগীর জন্য তা ছিল অমানুষিক যন্ত্রণা। অবশ্য সেটা করা ছাড়া আসলে কোনো উপায়ও ছিল না চিকিৎসকদের। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে অস্ত্রোপচারে ক্লোরোফর্মের ব্যবহার শুরু হয়। সেজন্য স্কটিশ চিকিৎসক জেমস ইয়াং সিম্পসনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেটাও আসলে তিনি আবিষ্কার করেন প্রায় হঠাৎ করে।

একটা কার্যকর চেতনানাশকের খোঁজে তিনি অনেকদিন ধরেই গবেষণা চালাচ্ছিলেন। সেজন্য একের পর এক রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের ওপর পরীক্ষা করে দেখতেন। কিন্তু কোনোটাতেই প্রত্যাশিত ফল পেতেন না। একদিন দোকান থেকে ক্লোরোফর্ম এনে বাসায় কিছু অতিথিদের ওপর প্রয়োগ করলেন। শুরুতে তাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল। কিন্তু তারপরই বলা নেই কওয়া নেই—অজ্ঞান। তাদের ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে। এভাবেই ক্লোরোফর্মকে চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায় বলে সিদ্ধান্তে আসেন সিম্পসন। 

ক্লোরোফর্মের থ্রিডি মডেল
উইকিপিডিয়া

যাহোক, এ গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বস্তুটি আবিষ্কার করতেও বিজ্ঞানীদের লেগেছে অনেক দিন। শুরুটা হয়েছিল ১৫ শতকের দিকে। সে সময় আলকেমিস্ট ও প্রকৃতিবিদেরা খেয়াল করেন, পিঁপড়ার ঢিবি থেকে একধরনের গ্যাস বেরিয়ে আসে। সেই গ্যাস কিছুটা অম্লীয় বা অ্যাসিডিক। সেটা দেখে পরের শতকে বিষয়টা পরীক্ষার কথা ভাবেন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ জন রে। ১৬৭১ সালের দিকে এক গাদা লাল পিঁপড়া সংগ্রহ করেন তিনি। সেগুলো পাতন করে পান এক তরল পদার্থ। সেটা অম্লীয়। কাজেই এর নাম দেওয়া হলো ফরমিক অ্যাসিড (Formic acid)। লাতিন শব্দ ফরমিকা অর্থ পিঁপড়া। তাই এমন নাম।

নামটাকে ভালোই বলতে হবে, কারণ লাল পিঁপড়ার কামড়ে যে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হয়, তার পেছনে রয়েছে ওই ফরমিক অ্যাসিড। আসলে পিঁপড়ার কামড়ের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ ফরমিক অ্যাসিড আমাদের মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। সেটাই জ্বালাপোড়ার জন্য দায়ী।

ফরমিক অ্যাসিড যৌগ গঠিত হয় একটা কার্বন পরমাণু দিয়ে। যার সঙ্গে একটা হাইড্রোজেন পরমাণু, একটা অক্সিজেন পরমাণু এবং হাইড্রোজেন-অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটা হাইড্রোক্সিল গ্রুপ যুক্ত থাকে। সংকেত CH2O2 বা HCOOH। এরকম রাসায়নিক গঠনের সামান্য কিছু পরিবর্তন করা হলেও নতুন যৌগের নামের সঙ্গে ‘ফরমিক’ শব্দটির ফরম (Form) অংশটি যুক্ত থাকে। রসায়নের নামকরণের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা হরহামেশাই দেখা যায়।

বোতলবন্দী ক্লোরোফর্ম
উইকিপিডিয়া

যেমন হাইড্রোক্সিল গ্রুপটা যদি একটা ক্লোরিন পরমাণু এবং অক্সিজেন পরমাণুটি যদি দুটি ক্লোরিন পরমাণু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে পাওয়া যাবে নতুন একটা যৌগ। তার নাম ক্লোরিনেটেড ফরমিক অ্যাসিড। এর সংকেত CHCl3। একেই সংক্ষেপে বলা হয় ক্লোরোফর্ম। সাধারণ মানুষের কাছে এই নামটিই বেশি পরিচিত। তবে সাধারণ মানুষ তেমন না জানলেও রসায়নবিদেরা এর সঙ্গে পিঁপড়ার সম্পর্কটা জানেন। যাহোক, এখন ক্লোরিনের বদলে যদি ব্রোমিন বা আয়োডিন যুক্ত করা হয়, তাহলে নতুন যৌগগুলোর নাম হবে যথাক্রমে ব্রোমোফর্ম ও আয়োডোফর্ম।

ক্লোরোফর্ম প্রথম সংশ্লেষণ করা হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে। তবে সেজন্য কাউকে একক কৃতিত্ব দেওয়া হয় না। ১৮৩১ সালের দিকে একইসঙ্গে বেশ কয়েকজন রসায়নবিদ আলাদা আলাদাভাবে এই জৈবযৌগটি সংশ্লেষণ করে। এটা খুবই উদ্বায়ী, বর্ণহীন ও ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত। শক্তিশালী চেতনানাশক হিসেবে চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ব্যবহার রয়েছে। এ ছাড়া শিল্পক্ষেত্রে কাঁচামাল ও হিমায়ক হিসেবেও কাজে লাগে ক্লোরোফর্ম।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা