অম্ল ও ক্ষার আসলে কী

অম্ল আর ক্ষার, যেন সাপে-নেউলে সম্পর্ক। শক্তি বেশি হলে একে অন্যকে নিস্ক্রিয় করতে দ্বিধা করে না। আবার গণতান্ত্রিকও বটে, কম শক্তি হলে কখনো ছাপিয়ে যায় না অন্যকে। কিন্তু অম্ল-ক্ষার আসলে কী? এদের শক্তিই বা কী? অম্ল-ক্ষার বোঝার উপায়?

অম্ল-ক্ষারের সঙ্গে পানির গভীর সম্পর্কছবি: সংগৃহীত

অম্ল-ক্ষারের সঙ্গে পানির সম্পর্ক গভীর।  পানি গঠিত হয় একটি অক্সিজেন আর দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে (H2O)। পানি ভাঙলে তা একটা প্রোটন (H+) আর একটা হাইড্রোক্সাইড আয়ন (OH-) উত্পন্ন করে। প্রোটন হলো একটি হাইড্রোজেনের ধনাত্মক আয়ন। আর হাইড্রোক্সাইড হলো একটা হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত ঋণাত্মক আয়ন।

২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ পানি অল্প পরিমাণ ভেঙে প্রোটন আর হাইড্রোক্সাইডে পরিণত হয়। পানি ভাঙার সময় সমপরিমাণ প্রোটন আর হাইড্রোক্সাইড তৈরি হয়। তাই এই পানি অম্লও নয়, ক্ষারও নয়। কিন্তু কোনো কারণে প্রোটনের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাকে বলা হয় অম্ল বা অম্লীয়। আবার হাইড্রোক্সাইড আয়নের সংখ্যা বেড়ে গেলে তা ক্ষার বা ক্ষারীয়।

এমন অনেক পদার্থ আছে, যাতে হাইড্রোজেন বা হাইড্রোক্সিল থাকে। যেসব পদার্থ পানিতে যোগ করলে প্রোটন দিতে পারে সেগুলো অম্ল। যেমন সিরকা অম্ল, কারণ পানিতে তা প্রোটন দেয়। তেমনিভাবে পানে যে চুন খাওয়া হয় তা ক্ষার, কারণ চুন দিতে পারে হাইড্রোক্সাইড আয়ন।

অম্লের স্বাদ সাধারণত টক। এগুলো সব কম শক্তির বা দুর্বল অম্ল। শক্তিশালী অম্লের মধ্যে আছে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডটিই আমাদের পাকস্থলীতে খাবার হজম করতে সহায়তা করে। সাবানে থাকে ক্ষার। এ জন্য সাবান পিচ্ছিল হয়। টয়লেট বা বেসিন পরিষ্কার করার জন্য যে হারপিক ব্যবহার করা হয়, তা-ও ক্ষার।

আচ্ছা, অম্ল আর ক্ষার একসঙ্গে যোগ করলে কী হবে? প্রোটন আর হাইড্রোক্সাইড মিলে পানি হয়ে যাবে। এ জন্যই এদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। অম্লের পরিমাণ বেশি হলে কিছু অতিরিক্ত প্রোটন থেকে যায়। তাতে পুরো দ্রবণ হবে অম্লীয়। উল্টোভাবে হাইড্রোক্সাইড অতিরিক্ত হলে দ্রবণ হবে ক্ষারীয়।

এবার দেখা যাক অম্ল-ক্ষারের শক্তি। যত বেশি হাইড্রোক্সাইড থাকবে দ্রবণে, তত শক্তিশালী ক্ষারীয় দ্রবণ। আবার প্রোটনের সংখ্যা বেশি হলে অম্লের শক্তি বাড়বে।

অম্ল-ক্ষারের শক্তি মাপার নানা স্কেল বা মাপকাঠি আছে। সবচেয়ে প্রচলিত পিএইচ (pH) স্কেল। স্বাভাবিক তাপমাত্রার বিশুদ্ধ পানির পিএইচ ৭। এই পানির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব সমান। কোনো দ্রবণের পিএইচ ৭-এর যত নিচে, অম্লত্ব তত বেশি। পিএইচের মান কমতে কমতে শূন্যও হতে পারে। অতি উচ্চ ঘনমাত্রায় দ্রবণের পিএইচের মান ঋণাত্মকও হতে পারে। আর ৭-এর ওপরে হলে তা ক্ষার। যত বেশি হবে, তার ক্ষারত্ব তত বেশি।

দ্রবণে প্রোটনের নাকি হাইড্রোক্সাইডের সংখ্যা কোনটা বেশি, আছে তা বোঝার জন্য নির্দেশক ব্যবহার করা হয়। এগুলো সব সময় দুটি অংশ দিয়ে গঠিত। প্রথম অংশ একটু জটিল আকৃতির। সংক্ষেপে লেখা হয় In- বা In+, বাকি অংশ হবে যথাক্রমে প্রোটন বা হাইড্রোক্সাইড। রসায়নের ভাষায় InH বা InOH। নির্দেশকগুলো খুব দুর্বল অম্ল বা দুর্বল ক্ষার। কোনো দ্রবণে যদি ইতিমধ্যে অনেক প্রোটন থাকে, অন্য কথায় অম্লীয় হয়, তাহলে InH আকারের নির্দেশক সহজে প্রোটন ছাড়তে পারে না। আবার দ্রবণে বেশি হাইড্রোক্সাইড থাকলে InOH নির্দেশকগুলো হাইড্রোক্সাইড ছাড়তে পারে না। অর্থাত্ অম্লীয় ও ক্ষারীয় অবস্থায় নির্দেশকগুলো থাকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায়। এসব ভিন্ন অবস্থায় নির্দেশক আলাদা রং দেখায়। কখনো রংহীন, কখনো গোলাপি, কখনো রক্তলাল বা হলুদ।

সবচেয়ে পরিচিত নির্দেশক লিটমাস কাগজ। ছোট্ট এ কাগজের টুকরা দিয়ে সহজেই যেকোনো দ্রবণ অম্লীয় না ক্ষারীয়, তা বোঝা যায়। দ্রবণ যদি অম্লীয় হয় লিটমাস কাগজের রং হয় লাল, ক্ষারীয় হলে নীল। রং দেখানোর প্রক্রিয়া অন্য সব নির্দেশকের মতোই। এ ক্ষেত্রে লিটমাস অম্লীয় নির্দেশক। InH2 অবস্থায় রং থাকে লাল। ক্ষারীয় দ্রবণে দুটো প্রোটন দিয়ে হয়ে যায় নীল। অম্লীয় দ্রবণে দিলে দুটো প্রোটন নিয়ে লাল হয়।

একধরনের নির্দেশক ভিন্ন ভিন্ন পিএইচে বিভিন্ন রং দেয়। সাধারণত এগুলো অনেক নির্দেশকের মিশ্রণে তৈরি। একে বলা হয় সর্বজনীন নির্দেশক।

লিটমাস কাগজ

লিটমাস কোনো একটি পদার্থ নয়, মূলত ১০ থেকে ১৫টি রঞ্জক পদার্থের সংমিশ্রণ। বেশ কয়েক ধরনের শৈবাল থেকে লিটমাস আহরণ করা হয়। তারপর লিটমাসে রঙিন করা হয় চোষকাগজ (filter)। এই রঞ্জকের দুটি রং হতে পারে। অম্লীয় দ্রবণে লাল এবং ক্ষারীয় দ্রবণে নীল। অন্যান্য নির্দেশকের মতো এই ধর্ম ব্যবহার করে খুব সহজেই এর মাধ্যমে দ্রবণ অম্লীয় না ক্ষারীয় তা নির্ণয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে লিটমাস অম্লীয় নির্দেশক। লিটমাসের InH2 অবস্থায় রং থাকে লাল। ক্ষারীয় দ্রবণে যেহেতু অনেক OH- ( হাইড্রোক্সিল আয়ন) থাকে, তাই সহজেই দুটি প্রোটন ছেড়ে দিয়ে In-অবস্থাতেই চলে যায়। আর In- অবস্থায় লিটমাসের রং নীল। তাই লাল লিটমাস ক্ষারীয় দ্রবণে দিলে হয়ে যায় নীল। আবার অম্লীয় দ্রবণে দিলে দুটি প্রোটন নিয়ে হয়ে যায় লাল।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত