রসায়ন
কোল্ড ড্রিংকসের বুদবুদ রহস্য
বোতলের মুখ খুললেই হিসহিস করে, বিজবিজ করে বেরিয়ে আসে অনেকটা কোল্ড ড্রিংক। তবে পানীয়ের চেয়ে এ সময় বেশি দেখা যায় বুদবুদ। পানির ভেতরেই যেন এই বুদবুদ লুকিয়ে ছিল, ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়েছে দল বেঁধে। এগুলো আসে কোত্থেকে? কেন কোল্ড ড্রিংকসের বোতলের মুখ খুলতেই বেরিয়ে আসে বুদবুদ?
কাঠফাটা রোদ। পিপাসায় গলা শুকিয়ে এসেছে। তাড়াহুড়োয় দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংক কিনে নিলেন, দ্রুত খুললেন বোতলের মুখ, অমনি বিজবিজ করে বোতল থেকে বেরিয়ে পড়ল অনেকখানি পানীয়, সঙ্গে ভীড় করে এল অসংখ্য বুদবুদ। হাত মাখামাখি হয়ে একশেষ। কোল্ড ড্রিংক বা কোমল পানীয়ের বুদবুদ নিয়ে আমাদের সবারই কম-বেশি এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুকুমার রায় তাঁর ‘বিষম চিন্তা’ কবিতায় বিষয়টা বলেছেন এভাবে: ‘সোডার বোতল খুললে কেন ফঁসফঁসিয়ে রাগ করে?’
আসলেই, সোডা বা কোমল পানীয়ের এত রাগ কেন? এই বুদবুদ তৈরি হয় কীভাবে? বোতল খুললেই-বা হুড়মুড় করে সব বেরিয়ে পড়ে কেন? কারণটা কী?
এক কথায় উত্তর দিলে, বলতে হবে, কোমল পানীয়তে উচ্চচাপে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস তরল দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। সুযোগ পেলেই বুদবুদ আকারে বেরিয়ে আসে। একই কারণে পানীয়ের স্বাদ ঝাঁঝালো হয়। এবার বিষয়টা বিস্তারিত খুলে বলি।
যেমনটা বললাম, কোমল পানীয়তে আমরা যে বুদবুদ দেখি, তার কারিগর কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) গ্যাস। কার্বোনেটেড ড্রিংকগুলোতে প্রচুর পরিমাণে এই গ্যাস মেশানো থাকে। অন্যভাবে বললে, কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশানো থাকে বলেই এসব কোমল পানীয়কে কার্বোনেটেড ড্রিংক বলা হয়। (আর কার্বনেটের মধ্যকার সোডিয়াম লবণের জন্য অনেকে একে বলেন ‘সোডা’।) কার্বন ডাই-অক্সাইড আসলে একটি রংহীন ও গন্ধহীন গ্যাস। কোমলপানীয় বোতলজাত করার সময় উচ্চ চাপে এটি মেশানো হয়।
আধুনিক কার্বনেটেড ড্রিংকের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের যেতে হবে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ প্রিস্টলির কাছে। ১৭৭২ সালে যেকোনো পানীয়কে কার্বোনেটেড করার যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেন তিনি। এ জন্য তাঁকে কোমল পানীয় শিল্পের জনক বলা হয়। এরপর ১৭৯৪ সালে সুইস জুয়েলার জেকব স্কেউপ্পা সাধারণ পানি কার্বোনেটেড করে জেনেভায় তাঁর বন্ধুর কাছে বিক্রি করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়।
প্রথম দিকে বোতলজাত কার্বোনেটেড পানি ব্যবহৃত হতো ওষুধ হিসেবে। ফ্লেভার বা স্বাদ অনেক পরে যুক্ত হয়। ১৮২০-এর দশকে আদা এবং ১৮৩০-এর দশকে লেবুর স্বাদ যুক্ত কার্বোনেটেড ড্রিংক বাজারে আসা শুরু করে। পরে ১৮৮৬ সালে মার্কিন ফার্মাসিস্ট জন পেমবার্টন উদ্ভাবন করেন কোকাকোলা। সেটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম কোলাজাতীয় কোমল পানীয়। (কোলা মানে, যে কার্বনেটেড ড্রিংকের সঙ্গে কিছু মশলা ও ফ্লেভার বা স্বাদ মেশানো থাকে।)
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে হেনরির সূত্র অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে কোমলপানীয়তে উচ্চ চাপে দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বেরিয়ে আসবে
কোমল পানীয়তে কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশানোর কারণে শুধু যে বুদবুদ তৈরি হয়, তা নয়, বরং এটা পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে। কার্বনিক অ্যাসিডের স্বাদ কিছুটা ট্যাঙ্গি—বলা ভালো, ঝাঁঝালো টক ধরনের। কিংবা বলতে পারেন, একটু কষ ও অ্যাসিড স্বাদের। যাহোক, শুধু কার্বনিক অ্যাসিডই নয়, কোমল পানীয়ের স্বাদ বৃদ্ধিতে অনেক সময় আরও নানা ধরনের অ্যাসিড মেশানো হয়।
অ্যাসিড মানেই কিন্তু ভয়ংকর কিছু নয়। লেবুতেও অ্যাসিড থাকে। কোমল পানীয়ের অ্যাসিডটাও সেরকম, খাওয়ার জন্য নিরাপদ। তবে এর কিছু সমস্যাও আছে, বলা বাহুল্য। যেমন সব ধরনের অ্যাসিডই দাঁতের জন্য ক্ষতিকর, তা সে যত অল্প পরিমাণেই হোক না কেন। তবে দাঁতের চিকিৎসকেরা এই অ্যাসিড নয়, বরং কোমল পানীয়তে থাকা চিনির ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন। এ কথা জানা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ডেন্টাল অ্যাসেসিয়েশনের সূত্রে।
কোমল পানীয়তে কার্বন ডাই-অক্সাইড যুক্ত করে বোতলজাত করার পর অল্প তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। কারণ নিম্ন তাপমাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সাইড পানিতে ভালোভাবে দ্রবীভূত থাকে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে দ্রবণ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস হিসেবে বেরিয়ে আসে। যে কারণে, হয়তো খেয়াল করেছেন, সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা কোমল পানীয় খেয়ে ঠিক তৃপ্তি হয় না।
আবার কোমল পানীয়তে যখন কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশানো হয়, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই গ্যাস আকারে বেরিয়ে আসতে চায়। হেনরির সূত্রের সাহায্যে এ ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়। ইংরেজ রসায়নবিদ উইলিয়াম হেনরি ১৮০৩ সালে তরলে দ্রবীভূত গ্যাসের পরিমাণ ও তরলের চারপাশে বায়ুচাপের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখায় করতে একটি সূত্র আবিষ্কার করেন। সূত্রটি বলে, কোনো তরলের মধ্যে কী পরিমাণ গ্যাসীয় পদার্থ দ্রবীভূত থাকবে, তা নির্ভর করে তরলের চারপাশে ওই গ্যাসের চাপের ওপর। সম্পর্কটা সমানুপাতিক। অর্থাৎ চারপাশে ওই গ্যাসের চাপ বাড়লে তরলে বেশি গ্যাস দ্রবীভূত থাকতে পারে। চাপ কমলে কমে যায় তরলে দ্রবীভূত গ্যাসের পরিমাণ। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে হেনরির সূত্র অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে কোমলপানীয়তে উচ্চ চাপে দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বেরিয়ে আসবে।
কোমল পানীয় যখন বোতল বা ক্যানে সংরক্ষণ করা হয়, তখন ওপরের কিছুটা অংশ ফাঁকা থাকে। এই ফাঁকা স্থান মূলত বায়ুমণ্ডলীয় চাপের চেয়ে খানিকটা বেশি চাপে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস দিয়ে ভরা থাকে। আরও সঠিকভাবে বললে, এ চাপের পরিমাণ ১০১.৩২৫ কিলোপ্যাসকেল। অন্যভাবে বললে, কোমল পানীয়ের বোতলের ভেতর প্রতি ইঞ্চি জায়গায় প্রায় ছয় কেজির মতো চাপ বজায় থাকে। অর্থাৎ বোতলের ভেতরে খানিকটা ভিন্ন পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যেই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস দিয়ে ওই ফাঁকা অংশটুকু ভর্তি করা হয় হেনরির সূত্র মেনে। এখন কোমল পানীয়তেও মিশে আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস, আবার ওপরের ফাঁকা অংশটিতেও রয়েছে একই গ্যাস, যা চাপ প্রয়োগ করছে কোমল পানীয়ের ওপরে; এ কারণেই কার্বন ডাই-অক্সাইড কোল্ড ড্রিংকে ভালোভাবে মিশে থাকে।
এবারে একটা মজার জিনিস বলি। প্রতি ইঞ্চি জায়গায় কতটা চাপ থাকে, এটা যেহেতু জানলেন, তাই চাইলে বিষয়টা বাসায় পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এ জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ বোতলের আয়তন মেপে নিয়ে দেখতে হবে, কী পরিমাণ চাপ এটি সহ্য করতে পারবে। এরপর সেই পরিমাণ ওজন বোতলের ওপর চাপাতে হবে। সঠিক পরিমাণ ওজন চাপালে দেখবেন, বোতলের কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু অতিরিক্ত ওজন দিলে বোতলটি একসময় ফেটে যাবে! (পরীক্ষা করলে কিন্তু খানিকটা সতর্ক থেকে করতে হবে, এটুকু বলে রাখছি।) যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি।
যখন কোমল পানীয়ের বোতল খোলা হয়, তখন উচ্চ চাপে থাকা ভেতরের কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশে যায়, ফলে বোতলের ভেতর কার্বন ডাই-অক্সাইডের চাপ কমে। এই সুযোগে পানীয়তে মিশে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের অণুগুলো পড়িমড়ি করে ছুটে বেরিয়ে আসে। কার্বন ডাই-অক্সাইড যেহেতু গ্যাস, তাই চাপ কমে যাওয়ামাত্র এটি তরল থেকে গ্যাসে পরিণত হয়। আর বাতাসটা পানীয়তে থাকায় চারপাশে পানির আস্তরণে বাতাস দেখতে গোল দেখায়। এগুলোকেই আমরা বলি বুদবুদ। (বুদবুদের এই বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝতে পানি, তরল বা প্রবাহীর সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটান সম্পর্কে জানতে হবে। আগ্রহীরা হয়তো জানেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের দেশে বিষয়টি পড়ানো হয়।)
যাহোক, হঠাৎ করে চাপ অনেক বেশি থেকে কম হয়ে গেলে প্রচুর পরিমাণ বুদবুদ একসঙ্গে তৈরি হয়। এত বুদবুদের জায়গা বোতলের ওই অল্প খানিকটা ফাঁকা জায়গায় হয় না। তাই বুদবুদ—বলা ভালো, কোমল পানীয়—পড়িমড়ি করে বোতল থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। পানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বুদবুদ বের হওয়ার সময় বিজবিজ ধরনের শব্দ হয়।
বোতল খোলার আগে যখন ঝাঁকানো হয়, তখন কোমল পানীয়তে দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইডের অণুগুলো মুক্ত হয়ে ওপরের ফাঁকা জায়গায় জমা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে বোতলের ভেতর চাপ বাড়ে। এই চাপ দ্রুত মুক্ত করা হলে, অর্থাৎ ঝাঁকানোর পরপর বোতলের মুখ খুলে নিলে, আরও দ্রুত আরও বেশি করে দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসে পরিণত হয়। ফলে অনেকটা বুদবুদ (এবং কোমল পানীয়) উপচে পড়ে।
হঠাৎ করে চাপ অনেক বেশি থেকে কম হয়ে গেলে প্রচুর পরিমাণ বুদবুদ একসঙ্গে তৈরি হয়। এত বুদবুদের জায়গা বোতলের ওই অল্প খানিকটা ফাঁকা জায়গায় হয় না। তাই বুদবুদ—বলা ভালো, কোমল পানীয়—পড়িমড়ি করে বোতল থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ে
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রায় ০.০৪ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। হেনরির সূত্র আমাদের বলে, কোমল পানীয়ের বোতল খুললে এতে দ্রবীভূত গ্যাস বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো সমান অনুপাতে মিশে থাকতে চায়। ফলে ধীরে ধীরে গ্যাস বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। যতক্ষণ না দুইয়ের অনুপাত সমান হচ্ছে, ততক্ষণ কোমল পানীয়ের দ্রবণ থেকে গ্যাস বেরিয়ে যায়। এ কারণে দেখা যায়, খুলে রাখা কোমল পানীয়তে একসময় আর ঝাঁঝ থাকে না।
তা ছাড়া বোতল থেকে গ্লাসে ঢালার সময় বেশি বুদবুদ দেখা যায়। এর কারণ, ঢালার সময় তরলের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বেশি থাকে। ফলে পানীয়তে মিশে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়ার বেশি সুযোগ পায়। আপনি চাইলেই ঢালার সময় বুদবুদের পরিমাণ কমাতে পারেন। এ জন্য গ্লাস কাত করে ধরে ভেতরের গায়ের সঙ্গে বোতলের মুখ মিলিয়ে ঢালতে হবে। এতে তুলনামূলক কম সারফেস এরিয়া (পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল) তৈরি হবে। ফলাফল, বুদবুদও হবে কম।