অন্য ধাতুকে সত্যিই স্বর্ণে পরিণত করা সম্ভব!
খ্যাতি ও সম্পদের লোভে প্রাচীন এবং মধ্যযুগে বিভিন্ন দেশে সাধারণ ধাতুকে সোনায় রূপান্তরের চেষ্টা চলতো। বর্তমানে এ পদ্ধতিকে বলা হতো ‘ক্রিসোপোইয়া’ (Chrysopoeia)। বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষ একে অবাস্তব মনে করেন। কিন্তু সত্যিই কি এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে, যেখানে ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করা সম্ভব?
বিজ্ঞানীদের মতে, অন্যান্য ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করা সম্ভব। তবে তা করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে, তা থেকে লাভ করা সম্ভব নয়। দার্শনিক জোসিমোসের এক অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল। তিনি ভাবতেন, সাধারণ কম মূল্যের ধাতুকে স্বর্ণে রূপান্তর করা আত্মার শুদ্ধির একটি উপায়। তাঁর কাছে এই কাজের সঙ্গে মিশে ছিল গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ।
জোসিমোসের এই দার্শনিক ভাবনা যখন হাজার বছর পর মধ্যযুগীয় ইউরোপে নতুন করে মাথাচাড়া দিল, তখন তার পেছনের কারণটা আর মোটেও আধ্যাত্মিক রইল না। তখন ইউরোপে ক্ষমতা আর সম্পদের জন্য চলছিল রেষারেষি। ধনী আর ক্ষমতাশীলরা স্বর্ণ দেখছিল সম্পদ অর্জনের এক নিশ্চিত পথ হিসেবে। তাঁরা রসায়ন নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। আলকেমিস্টরা দিনরাত পরিশ্রম করতে লাগলেন, কীভাবে সাধারণ সস্তা লোহা বা সীসাকে স্বর্ণে পরিণত করা যায়। তাঁদের কাছে ক্রিসোপোইয়া ছিল রাতারাতি ধনী হওয়ার মাধ্যম।
তবে জোসিমোসের সেই দার্শনিক ভাবনা আরও আগে আলকেমির উৎপত্তি হয়েছিল প্রাচীন মিশরে। নীল নদের উর্বর উপত্যকার ‘কেমেট’ বা ‘কালো মাটি’ নামের সঙ্গে মিল রেখে এই বিদ্যার আরবি নাম হয়েছিল ‘আল-কিমিয়া’। সেখান থেকে পরে আলকেমি শব্দের উদ্ভব। মিশরীয়রা ধাতুবিদ্যা, মমি তৈরি এবং বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল, যা আলকেমির প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে। পরে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আলকেমির জ্ঞান ইসলামী বিশ্বে প্রবেশ করে এবং সেখানে তা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম বিজ্ঞানীরা শুধু দার্শনিক তত্ত্বে সীমাবদ্ধ না থেকে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির ওপর জোর দেন, যা আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পর্তুগালের নোভা ইউনিভার্সিটি লিসবনের প্রত্নতাত্ত্বিক উম্বার্তো ভেরোনেসি এই ধারণা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘প্রাচীন প্রাকৃতিক দার্শনিকেরা মৌলিক ধাতুগুলোকে অপূর্ণ ভাবতেন। তাঁরা মনে করতেন, এই ধাতুগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে একসময় সবচেয়ে বিশুদ্ধ ধাতু, অর্থাৎ স্বর্ণে পরিণত হবে। তবে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক দীর্ঘ সময় লাগত। মূল সমস্যা ছিল এটাই।’
প্রাচীনকালে আলকেমিস্টরা বিশ্বাস করতেন, একটি বিশেষ পদার্থ তৈরি করতে পারলে তাঁরা যেকোনো সাধারণ ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করতে পারবেন। এই বিশেষ পদার্থের নাম ছিল ‘ফিলোসফারস স্টোন’ (Philosopher's Stone)। বাংলায় একে বলা হয় পরশ পাথর। তাঁদের ধারণা ছিল, মৌলিক ধাতুগুলো পারদ, সালফার ও লবণ দিয়ে তৈরি। তাই এই উপাদানগুলোকে নতুন ভাবে সাজিয়ে এবং এর ভেতরের অপবিত্রতা দূর করতে পারলেই যেকোনো ধাতুকে স্বর্ণে রূপান্তর করা সম্ভব।
প্রত্নতাত্ত্বিক উম্বার্তো ভেরোনেসি বলেন, ‘তখন প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী, ক্রিসোপোইয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ধারণা ছিল। সে কালে কেউই এই কাজ করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ করত না।’
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসার ঘটলে আলকেমির এই ধারণাগুলো ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে। রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার নতুন শাখাগুলো আলকেমির জায়গা দখল করে নেয়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় এক শতাব্দী ধরে পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা এই কিংবদন্তি রূপান্তরের গোপন রহস্য নিজেদের কাছে রেখেছিলেন।
বর্তমানে আমরা জেনেছি, একটি মৌলের পরিচয় তার নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয়। মূল্যবান ধাতু স্বর্ণের পরমাণুতে ৭৯টি প্রোটন থাকে। আর সীসার পরমাণুতে থাকে ৮২টি প্রোটন।
সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের পদার্থবিদ আলেকজান্ডার কালওয়েট বলেন, ‘নিউক্লিয়াসকে শক্তিশালী বল একত্রিত করে ধরে রাখে। এই কারণে নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটন বা নিউট্রন আলাদা করা খুব কঠিন।’
তবে পরমাণুর এই মৌলিক উপাদানগুলো পুনর্বিন্যাস করতে পারলে একটি মৌলকে অন্য মৌলে রূপান্তর করা সম্ভব। পদার্থবিদ আলেকজান্ডার কালওয়েট বলেন, ‘আপনার কাছে যদি যথেষ্ট শক্তি থাকে, তাহলে এমন কাজ করতে পারেন। সীসার নিউক্লিয়াস থেকে তিনটি প্রোটন সরিয়ে ফেললে সেটি আসলে স্বর্ণে পরিণত হয়।’
অন্যান্য সাধারণ ধাতুকে স্বর্ণে রূপান্তরের প্রথম সফল খবর পাওয়া যায় ১৯৪১ সালে। সে সময় হার্ভার্ডের বিজ্ঞানীরা একটি পার্টিকেল এক্সিলারেটর ব্যবহার করে পারদের পরমাণুর ওপর লিথিয়াম এবং ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াস নিক্ষেপ করেন। পারদের পরমাণুতে স্বর্ণের চেয়ে একটি প্রোটন বেশি থাকে। এই উচ্চ শক্তির কণাগুলো পারদের নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটন এবং নিউট্রনকে বের করে দেয়। ফলে স্বর্ণের তিনটি স্বল্পস্থায়ী এবং তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি হয়, যা দ্রুত ক্ষয়ে যায়।
চল্লিশ বছর পর, ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে রসায়নে নোবেল লরিয়েট গ্লেন সিবর্গ একই ধরনের একটি অসাধারণ সাফল্য পান। তাঁর দল আপেক্ষিক গতিতে (আলোর গতি) সংঘর্ষের মাধ্যমে বিসমাথ নিউক্লিয়াসের ভাঙন নিয়ে গবেষণা করছিল। এ সময় তাঁরা একটি পার্টিকেল এক্সিলারেটর যন্ত্রে কার্বন ও নিয়নের নিউক্লিয়াস দিয়ে বিসমাথের পরমাণুকে আঘাত করেন। ফলে সেই পদার্থের কয়েক হাজার পরমাণু স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে পার্টিকেল এক্সিলারেটর নিয়ে গবেষণা করা দলগুলো তাঁদের পরীক্ষায় উপজাত হিসেবে স্বর্ণের তৈরির খবর প্রকাশ করেন। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে আলেকজান্ডার কালওয়েটের দল আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে সীসার নিউক্লিয়াস বা আয়নের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে গবেষণা করছেন।
পদার্থবিদ আলেকজান্ডার কালওয়েট বলেন, ‘যখন আমরা দুটি সীসা নিউক্লিয়াসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটাই, তখন প্রোটন ও নিউট্রনের ভেতরের কোয়ার্কগুলো মুক্ত হয়ে যায়। এটি খুব অল্প সময়ের জন্য পদার্থের এমন একটি অবস্থা তৈরি করে, যা মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময় বিগ ব্যাংয়ের কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড পরে বিদ্যমান ছিল। একে কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা বলে।’
এই মুখোমুখি সংঘর্ষগুলো এত তীব্র হয় যে প্রোটন এবং নিউট্রন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে তুলনামূলক কম শক্তির সংঘর্ষে কণাগুলো খুব কাছাকাছি আসে কিন্তু পরস্পরকে স্পর্শ করে না। ফলে একটি শক্তিশালী তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা সীসা নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটনগুলোকে আলাদা করে দেয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিন বছর ধরে চলা এক গবেষণায় দলটি প্রায় ২৯ ট্রিলিয়ন ভাগের এক গ্রাম স্বর্ণ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
তবে আলকেমিস্টদের স্বপ্ন পূরণ হওয়া সত্ত্বেও পারমাণবিক পদার্থবিদদের কণাত্বরক যন্ত্রে তৈরি স্বর্ণ থেকে লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের মতো একটি যন্ত্র তৈরি এবং চালানোর খরচ উৎপাদিত স্বর্ণের দামের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি। অনুমান করা হয়, ১৯৮০-এর দশকে বিজ্ঞানী সিবর্গের পরীক্ষাগুলো থেকে যে পরিমাণ স্বর্ণ তৈরি হয়েছিল, তার দামের চেয়ে প্রায় এক ট্রিলিয়ন গুণ বেশি খরচ হয়েছিল।
এ ছাড়াও এমন সফল সংঘর্ষ খুব বিরল। তাই রূপান্তরিত হওয়া সামান্য কিছু পরমাণু শনাক্ত করতে গবেষকদের কোটি কোটি ডেটা পয়েন্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পদার্থবিদ আলেকজান্ডার কালওয়েট বলেন, ‘১৯৪০ সাল থেকে এমন অনেক পরীক্ষা হয়েছে, যেখানে স্বর্ণ তৈরি করা গেছে। তবে সবগুলোরই একটি সাধারণ দিক হলো, এদের কোনোটিই লাভজনক হওয়ার কাছাকাছিও নয়।’