আলকেমি থেকে রসায়ন

১৭ শতক। প্যারিস।

গবেষণাগারে বসে আছেন নিকোলাস ফ্লামেল। মুখে অনেক দিনের না কাটা দাঁড়ি, মাথায় এলোমেলো চুল। নিবিড় মনযোগে কী সব যেন মেশাচ্ছেন। একটুখানি থামলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন হাতের বিকারের দিকে। তারপর গাল দিলেন বিড়বিড় করে। এবারও হলো না।

কত নির্ঘুম রাত, কঠোর পরিশ্রম! সবকিছুর উদ্দেশ্য একটাই। পরশপাথর বানানো। এর আরেক নাম ‘এলিক্সার অব লাইফ’। প্রাচীন ভারত ও তিব্বতের দিকে এটি পরিচিত শাংগ্রিলা নামে। কেউ কেউ আবার একে বলেন সাম্ভালা। হ্যারি পটারে একে বলা হয়েছে “ফিলোসফার'স স্টোন”। আসলে একই জিনিস—পরশপাথর। সাধারণ যেকোনো পদার্থকে যে বদলে দেয় স্বর্ণে। মানুষকে দেয় অমরত্ব।

ওপরের দৃশ্যকল্পটি আসলে সত্যি, তেমনটা মনে হয় না। ইতিহাস বলে, নিকোলাস ফ্লামেল আসলেই ছিলেন। তবে তিনি পরশপাথর বানানোর চেষ্টা করেছেন, এমন কোনো সত্যিকার প্রমাণ ইতিহাসে মেলে না। কারণ, নিকোলাস ফ্লামেল বেঁচে ছিলেন ১৩৩০ থেকে ১৪২৮ সাল পর্যন্ত। আর ফ্লামেলের পরশপাথর গবেষণার কিংবদন্তী ১৭ শতকের। এই কিংবদন্তী মতে, ফ্লামেল শেষপর্যন্ত আসলেই বানিয়েছিলেন পরশপাথর। পেয়েছিলেন অমরত্ব। এ ধরনের বক্তব্য নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দেয়। মেলে না এর কোনোটির জবাব। তবে যেকোনো পদার্থকে স্বর্ণে পরিণত করা ও অমরত্ব লাভের চেষ্টা করেছেন, এমন অনেক মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় ইতিহাসে। তাদের নাম আলকেমিস্ট। আর, পরশপাথর বানানোর চেষ্টায় চর্চিত জ্ঞানের নাম আলকেমি। বাংলায় বলা হয় অপরসায়ন।

আলকেমি নামটি এসেছে ‘আল কিমিয়া’ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে আরবরা যখন মিশর দখল করে নেয়, তখন তারা মিশরের এ নাম দেয়। ‘আল কিমিয়া’ অর্থ ‘কালো মাটির দেশ’। মিশরের শুকনো মরু মাটির রং ছিল লাল। নীলনদের পানি এর যে অংশটিতে এসে পড়ত, সে অংশ পানির ছোঁয়ায় কালো হয়ে যেত। সেজন্যই এমন নামকরণ। 

ইতিহাসে পাওয়া যায়, এরকম এক বিখ্যাত আলকেমিস্টের নাম জোসোমিস অব প্যানোপোলিস। মানে, প্যানোপোলিসের জোসিমোস। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের শেষ ও চতুর্থ শতকের শুরুর দিকের মানুষ তিনি। সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন এ কাজে। এরকম আরও অনেক বিখ্যাত আলকেমিস্ট আছেন। তাঁদের নামের তালিকা না দিয়ে আমরা বরং ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত আলকেমিস্ট ও পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্রের গল্প শুনি। তিনি আইজ্যাক নিউটন।

প্রায় ৩০ বছর ধরে নিউটন পরশপাথর বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিখ্যাত সব আলকেমিস্টের লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র ইত্যাদি পড়ে বের করতে চেয়েছেন পরশপাথরের রহস্য। কিন্তু তিনি সফল হননি। প্রশ্ন হলো, নিউটন কেন আলকেমি চর্চা করেছিলেন? তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল? শুধুই স্বর্ণ বানানো? অমরত্ব? হয়তো। তবে আরেকটি বড় কারণ ছিল নিউটনের এই চর্চার। সবকিছুর তত্ত্ব আবিষ্কার। সবকিছুকে এক সুতোয় গাঁথা।

১৬৬৫ সালে বুবোনিক প্লেগে ইউরোপ যখন জর্জরিত, সব গুছিয়ে নিউটন তখন চলে যান নিজের গ্রামের বাড়ি, কেমব্রিজ থেকে ৬০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের কোলস্টারওয়ার্থ গ্রামে। সেখানে দুই বছর নিরবে-নিভৃতে কাজ করেন গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস, আলোর প্রকৃতি, মহাকর্ষ সূত্র ইত্যাদি। চিরায়ত গতিবিদ্যা ও মহাকর্ষ সূত্রের মাধ্যমে তিনি পৃথিবী ও মহাকাশের অন্যান্য সব মহাজাগতিক বস্তুকে বেঁধে ফেলেন এক সুতোয়। যে বলের কারণে আপেল মাটিতে পড়ে, সেই একই বলের কারণে জন্ম নেয় নক্ষত্র, চাঁদ ঘুরে চলে পৃথিবীর চারপাশে। এই যে সবকিছুকে এক সুতোয় গাঁথা, এই প্রচেষ্টা ছিল নিউটনের মননে-মস্তিষ্কে। সঙ্গে ছিল খ্যাতির লোভ। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তাঁর সূত্রগুলোর রাজত্ব তখন শুরু হয়ে গেছে।

নিউটন ভেবেছিলেন, পদার্থের ক্ষুদ্রতম এককে, অর্থাৎ পরমাণু পর্যায়ে নেমে গেলে রসায়নের ব্যাখ্যাও পাওয়া যাবে। অর্থাৎ তাঁর আবিষ্কার রসায়নের জগতটাকেও দখল করে নেবে সদর্পে। কিন্তু ১৯ শতকের শেষে এবং ২০ শতকের শুরুতে দেখা গেল, গ্রহ থেকে ছোট হতে হতে বল পর্যন্ত কাজ করলেও, আরো ছোট হয়ে পরমাণুর জগতে এসে চিরন্তন বলবিদ্যা অসহায় হয়ে পড়ে। যে ধারণার ওপর নিউটনের চিরন্তন বলবিদ্যা গড়ে উঠেছে, পরমাণু এবং তার গাঠনিক কণাদের জগতে এসে এরা রাতারাতি ভেঙ্গে পড়ে। একদমই কাজ করে না। কাজেই, এবারেও হলো না। সেই সমস্যা অবশ্য রয়ে গেছে আজও। বিজ্ঞানীরা আজও খুঁজে ফিরছেন সবকিছুর তত্ত্ব। চেষ্টা করছেন নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের পরিমার্জিত রূপ সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সমন্বয় ঘটাতে। সে অন্য গল্প। প্রসঙ্গে ফিরি।

আলকেমি থেকে রসায়নের জন্ম কীভাবে হলো, সে গল্প শুনতে আরেকটু পেছনে ফিরে যাই। আগেই বলেছি, পরশপাথর একদিকে যেমন শরীরের সব ধরনের রোগ-জরা-ব্যাধি দূর করে মানুষকে অমরত্ব দেয়, তেমনি সব বস্তুকে পরিণত করে স্বর্ণে। আসলে, আলকেমিস্টরা ঠিক এটা ভাবতেন না। তাঁরা ভাবতেন, ‘স্বর্ণের কাছাকাছি’ যেসব বস্তু আছে, তাদেরকে পরশপাথর স্বর্ণে পরিণত করে। স্বর্ণের কাছাকাছি মানে, রঙের দিক থেকে কাছাকাছি হতে পারে। যেমন, প্রস্রাব বা বালি। কিংবা খনিজ, প্রাচীন কালের মানুষের কাছে যেগুলোকে গঠনের দিক থেকে মনে হতো স্বর্ণের মতো। যেমন, সীসা। বলা বাহুল্য, উদ্দেশ্য দুটোর কোনোটিই পূরণ হয়নি। কিন্তু পদার্থ নিয়ে আলকেমিস্টদের এসব বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কাজকর্মের ফলে তাঁরা পদার্থের ব্যাপারে চমৎকার অনেক জিনিস জানতে পেরেছিলেন। এই জ্ঞানটুকুই আসলে রসায়নের ভিত্তি বা বীজ হিসেবে কাজ করেছে। উদ্ভট দুরাশা থেকে জন্ম নিয়েছে সত্যিকারের নতুন এক বিজ্ঞান।

২.

আলকেমি থেকে রসায়নের জন্মের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দুটো জিনিস। বারো শতকের দিকে আলেকিমস্টরা শিখে ফেলেছিলেন এর একটি, পাতন। ইংরেজিতে বলে ডিস্টিলেশন। নিজেদের মতো করে তাঁরা পাতনযন্ত্রও বানিয়েছিলেন। পাতন মানে, বাষ্পীভবন বা ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় তরল মিশ্রণ থেকে উপাদানগুলোকে আলাদা করে নেওয়া। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি দরকার পড়ে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলো ভরের পরিমাপ। নির্দিষ্টভাবে ভর মাপতে শেখার ফলে মানুষ পদার্থের গায়ে সংখ্যা বসানোর ক্ষমতা পেয়ে গেছে। পারমাণবিক সংখ্যা। এই অর্জনের গুরুত্ব মোটেও হেলাফেলার মতো নয়। বাতাস, পানি, স্বর্ণ কিংবা অন্য যেকোনো ধরনের পদার্থের গায়ে যে অর্থপূর্ণ সংখ্যা বসানো সম্ভব—এই ভাবনাটাই তো অসাধারণ! একুশ শতকের শেষ প্রান্তে বসে পুরো ব্যাপারটাকে নিতান্ত সাধারণ মনে হলেও, প্রাচীনকালের হিসেবে বিষয়টা ছিল কল্পনাতীত। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে পদার্থ নিয়ে গবেষণা এবং পদার্থের রূপান্তরের বিষয়গুলো ভৌত বিজ্ঞানের আওতায় চলে আসে। তৈরি হয় গুণগত বা পদার্থের বৈশিষ্ট্যমূলক সবকিছুকে পরিমাপ করার একটা ব্যবস্থা। ফলে তাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনাকে পরীক্ষাগারে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখার উপায় চলে আসে বিজ্ঞানীদের হাতে। সহজ কথায়, পদার্থ নিয়ে মানুষের ভাবনাগুলো কতটা বাস্তব, তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার উপায় পেয়ে যান বিজ্ঞানীরা।

এক জিনিস থেকে অন্য কিছুতে রূপান্তরের আগে-পরে পদার্থটিকে মেপে নেওয়া আমাদেরকে এমন এক পথের সন্ধান দিয়েছে, যার ফলে আধুনিক রসায়নের সবকিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ধারণাটির নাম পরমাণু।

পরমাণুর ধারণা মানুষের ভাবনায় ঘুরে ফিরেছে দুই হাজারের বেশি সময় ধরে। সেই প্রাচীন গ্রীকদের সময় এ ধারণার শুরু। কোনো প্রমাণ ছিল না তাদের হাতে। তবু তারা মনে করত, মহাবিশ্বের সবকিছু নিশ্চয়ই কোনো ধরনের অদৃশ্য বীজ দিয়ে তৈরি। তাদের সেই ধারণা বিজ্ঞানী জন ডাল্টনের (১৭৬৬-১৮৪৪) হাতে বৈজ্ঞানিক রূপ পেয়েছিল।

বিক্রিয়ার ফলে বিক্রিয়ক পদার্থ ভিন্ন কিছুতে পাল্টে যায়। এর নাম উৎপাদ। বিক্রিয়ার আগে পরে বিক্রিয়ক ও উৎপাদ পরিমাপ করে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে ভদ্রলোক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পদার্থের সবচেয়ে ছোট অবস্থা—অর্থাৎ ‘মৌল’ এমন কিছু দিয়ে তৈরি, যাদেরকে ভাঙ্গা সম্ভব নয়। তিনি সেই জিনিসগুলোর নাম দেন পরমাণু। আর, এক পদার্থ থেকে অন্য পদার্থে রূপান্তরের সময় এই পরমাণুরা যে বদলে যাচ্ছে, সাধারণ পরিমাপ থেকেই এই হিসেবটা পাওয়া সম্ভব। আসলে এ সময় পরমাণুদের ভরের পরিবর্তন হয়। সেটা খেয়াল করলেই বোঝা যায় বিষয়টা।

পরমাণুকে বলা যায় রসায়নের মুদ্রা। প্রায় সব ধরনের রাসায়নিক ব্যাখ্যাই শেষ পর্যন্ত পরমাণুর কথা বলে। এদের কথা আলাদাভাবে যেমন বলা হয়, তেমনি তাদের দলবদ্ধ রূপের কথাও বলা হয়। এই দলবদ্ধ রূপকে আমরা বলি অণু। সবকিছুই পরমাণু দিয়ে তৈরি। আপনি চারপাশে যা কিছু দেখতে পাচ্ছেন কিংবা ধরতে পারেন—সব।

গাছ হোক কিংবা আপনার ঘরের চেয়ারটা, যে পৃষ্টাটার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ পড়ছেন—এসবও আসলে পরমাণুই। একটা পরমাণুকে আলাদা করে দেখতে গেলে সেটা খালি চোখে দেখা সম্ভব না। কিন্তু আপনি এক জীবনে যা কিছু দেখেছেন বা ধরেছেন—সবই আসলে পরমাণুর দল। সব ধরনের পদার্থই পরমাণুর দল, মানে অণু দিয়ে গঠিত। আর, আমরা চারপাশে তাকালেই এদেরকে দেখতে পাই। এই যে আলকেমি থেকে শেখা জ্ঞান থেকে পরমাণুর ধারণা, এর মাধ্যমেই জন্ম হয় রসায়নের। আর, আগেই যেমন বলেছি, এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গড়ে দেন ব্রিটিশ রসায়নবিদ জন ডাল্টন তাঁর ‘পরমাণুবাদ তত্ত্ব’-এর মাধ্যমে। জন ডাল্টন ও তাঁর তত্ত্বের হাত ধরে রসায়ন কীভাবে এগিয়ে গেল, সে আরেক গল্প। পরের কোনো লেখায় সে গল্প শোনানো যাবে।

লেখক: সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: হোয়াট ইজ কেমিস্ট্রি, পিটার অ্যাটকিনস

নিউটনের জীবন ও বিজ্ঞান, প্রদীপ দেব, প্রকাশ: বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২০

উইকিপিডিয়া

ব্রিটানিকা