কাদার আগ্নেয়গিরি!

ইন্দোনেশিয়ার প্রসাশনিক বিভাগ রিজেন্সি সিদোরাজো। ২০০৬ সালের ২৯ মে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এক ধানচাষী কৃষক দেখলেন অদ্ভুত দৃশ্য। আগের দিনের সুন্দর সুফলা জমির মাটি এক রাতের ব্যবধানে ফেটে চৌচির। ফাটা জায়গাগুলো থেকে বের হচ্ছে বাষ্প।

সপ্তাহের খানেকের মধ্যেই নিচ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে পানি, ফুটন্ত কাদা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। গরম কাদায় ছেয়ে যেতে থাকে চারপাশ। পরিস্থিতি বিবেচনা করে গ্রাম ছাড়েন বাসিন্দারা।

সময় যতোই গড়াতে থাকে, ততই আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকে উত্তপ্ত কাদার স্তুপ। সপ্তাহ পেরোতেই পুরো গ্রাম কাদার নিয়ে ঢাকা পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে ইন্দোনেশিয়া সরকার প্রাচীর তুলে দেয় কাদার চারপাশে। সেই প্রাচীর ছাড়িয়ে কাদা ছড়াতে থাকে। পরে আরও উঁচু করে প্রাচীর তৈরি করে সরকার। একটা সময় কাদার উদগীরণ প্রায় থেমে যায়। ততদিনে কাদার স্তুপের নিচে ঢাকা পড়েছে প্রায় একডজন গ্রাম। ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ।

এমন অদ্ভুত ঘটনা পৃথিবীতে অবশ্য একেবারে নতুন নয়। ভূপৃষ্ঠ ফুড়ে কাদা, গ্যাস আর তরল পদার্থেই এই উদগীরণ ভূ-বিজ্ঞানীদের কাছে মাড ভলকানো বা কাদার আগ্নেয়গিরি নামে পরিচিত। ভূ-পৃষ্ঠের নিচ থেকে গলিত লাভা, ছাই ও ধোঁয়া বের হয়ে আসার স্থানকে বলা হয় আগ্নেয়গিরি। কাদার আগ্নেয়গিরি নামটা সাধারণ আগ্নেয়গিরি থেকেই এসেছে। সাধারণ আগ্নেয়গিরির সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, এখানে লাভার পরিবর্তে বের হয় উত্তপ্ত কাদামাটি। 

কাদার আগ্নেয়গিরি

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব আগ্নেয়গিরি থেকে কাদা উদগীরণ হয় নিরবে ও ধীরে ধীরে। তবে, মাঝে মাঝে বিপদজনক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। মিথেন খুবই দাহ্য গ্যাস। সামান্য স্ফুলিঙ্গের স্পর্শেই ধরে যায় আগুন। প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়েই কাদার আগ্নেয়গিরির দেখা মেলে। এর মাঝে ইন্দোনেশিয়া, আজারবাইজান, ত্রিনিদাদ, ইতালি এবং জাপান অন্যতম।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। কাদার আগ্নেয়গিরি বেলাতেও একই কথা প্রযেজ্য। ভূ-পৃষ্ঠের নিচের তরল পানি বা পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস যখন চাপের মুখে পড়ে তখন বাধ্য হয়ে ভূ-ত্বক ছেদ করে বেরিয়ে আসে বাইরে। তরল পদার্থ বাইরে আসার সময় ভূ-পৃষ্ঠের নিচ থেকে মাটি বালির আস্তরণ নিয়ে আসে কাদা রূপে। ফলে তৈরি হয় মাড ভলকানো বা কাদার আগ্নেয়গিরি।

চাপ ও ভূ-পৃষ্ঠের নিচে কী পরিমাণ তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ আছে তার ওপর নির্ভর করে কাদার আগ্নেয়গিরি উদগীরণ কতোটা বেশি কিংবা কতটা তীব্র হবে।

কাদার আগ্নেয়গিরি উদগীরণ হচ্ছে

নানাভাবে ভূ-গর্ভে তরল ও গ্যাস জমতে পারে। যেমন, পানি প্রবাহের কারণে ভূ-গর্ভে জমে পানি। উদ্ভিদ ও জীবদেহ কোটি কোটি বছর ধরে মাটি চাপা পড়ে জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম জাতীয় তরল ও গ্যাস।

ভূমিকম্প বা ভূ-গর্ভের টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে বাড়ে চাপ। এছাড়া মাটির নিচ থেকে তেল, গ্যাসের মতো খনিজ উৎপাদন সঠিক নিয়মে না করলেও আশেপাশে অঞ্চলের ভূ-গর্ভে বাড়তে পারে চাপ। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানব সৃষ্ট ঘটনার কারণেও এই কাদার আগ্নেয়গিরি তৈরি হতে পারে।

কাদার আগ্নেয়গিরি দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত নিচে থাকা পদার্থ বেরিয়ে আসতে পারে। তাই পৃথিবীতের ভেতরের রসায়ন এবং তাপমাত্রা কেমন তা নিয়ে গবেষণা করার জন্য কাদার আগ্নেয়গিরি চমৎকার একটি বিষয়।

সাধারণত কাদার এসব আগ্নেয়গিরি খুবই ছোট পরিসরে ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো হয় নিরাপদ। তবে, বড় পরিসরে কাদার আগ্নেয়গিরি যে মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তার বড় প্রমাণ ইন্দোনেশিয়ার ঘটনাটি।

লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: দ্য কনভারসেশন, উইকিপিডিয়া