রসায়ন
অণু, গন্ধ ও জীবন
ফুল, ফল, নানা ধরনের খাবার ও গায়ে মাখার সুগন্ধি—আমাদের জীবনে অনিবার্য। এই গন্ধ ছাড়া আমাদের জীবন কল্পনাও করতে পারি না। চায়ের গন্ধ না পেলে কি পুরো স্বাদ পাওয়া যাবে? যাবে না। অথচ এই গন্ধ নিয়ে অনেক কিছুই আজও অজানা। কেউ কেউ তো বলছেন, ছবি যেমন খুদে বার্তার মাধ্যমে পাঠানো যায়, গন্ধ কেন পাঠানো যাবে না?
গন্ধ ছাড়া কি জীবন ভাবা যায়? সংগীত ও রং ছাড়া যেমন আমাদের জীবন ভাবা যায় না, তেমনি প্রতিদিনের জীবনে গন্ধও অনিবার্য। সকালের চা, কফি কিংবা খাবার; উৎসব, এমনকি আমাদের প্রসাধনী, রোমান্স বা নানা রকম আচারের সঙ্গেও গন্ধ (Odor) জড়িয়ে আছে।
আমরা কি ভেবেছি, ভিন্ন ভিন্ন এই গন্ধের উৎস কী? সুগন্ধ হোক বা দুর্গন্ধ—সবই আসে অণু থেকে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই অণুগুলো হয় জৈব অণু বা যৌগ (Organic molecules)।
চায়ের সঙ্গে দারুচিনি মেশালে দারুণ একটা গন্ধ আসে কিংবা লবঙ্গ মেশালে। দারুচিনির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ মূলত আসে সিনামালডিহাইড (cinnamaldehyde) নামের একটা অণু থেকে। বাজারের বিভিন্ন খাবার ও পানীয়তে দারুচিনি ব্যবহার না করে শুধু এই রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার করেই দারুচিনির গন্ধ যুক্ত করা হয়।
ভারতবর্ষে চন্দনকাঠের ব্যবহার কয়েক হাজার বছরের। এ কাঠের চাহিদার মূল কারণ হলো, কাঠটির সুগন্ধ। কিংবা কর্পূরের কথা বলা যায়। খাওয়ার যোগ্য বিশেষ ধরনের কর্পূর যুক্ত করা হয় খাবারে। ভারতবর্ষে এই কর্পূরের ব্যবহারও হাজার বছরের বেশি সময় ধরে।
সংগীত সম্পর্কে যাঁদের সামান্য ধারণা আছে, তাঁরা নিশ্চয় জানেন, সংগীতে নোট বা স্বর ব্যবহার করা হয়। স্বর হলো মৌলিক বিষয়। একাধিক স্বর বা নোট মিলেও দারুণ সুর তৈরি হয়। গিটার বা পিয়োনোতে যেমন বলা হয় কর্ড। একটা কর্ড কয়েকটা নোটের সমন্বয়ে হয়। রঙের বেলাতেও কিন্তু তা–ই। দুটি রং মিশিয়ে আমরা ভিন্ন একটা রং পেয়ে যাই।
গন্ধের বেলাতেও তেমনই। একটা ফুল বা মসলা থেকে যে সুবাস পাই, সেটা কিন্তু অনেকগুলো অণুর মিশ্রণের গন্ধ। হয়তো সে মিশ্রণে একটি-দুটি অণুর অনুপাত বেশি থাকে। কিন্তু সংগীতের কর্ডের মতোই, কয়েকটা অণুর সমন্বয়ে একটা চমৎকার গন্ধের সৃষ্টি হয়। এটাকে সুরের ঐকতানের সঙ্গে তুলনা করা যায়—সুবাসের ঐকতান (Symphony of odor)।
মানুষ প্রকৃতি থেকে সুবাসের ঐকতান শিখেছে। প্রসাধনীর জগতে যত পারফিউম তৈরি করা হয়, সেগুলোতে একাধিক রাসায়নিক অণু ভিন্ন ভিন্ন অনুপাত ও ঘনত্বে ব্যবহার করা হয়। এভাবেই তৈরি করা হয় একটা সিগনেচার পারফিউম। যাঁরা এই কাজে পারদর্শী, তাঁদের বলা হয় মাস্টার পারফিউমার।
সারা পৃথিবীতে পারফিউম, কসমেটিক, টয়লেট্রিজ ও খাদ্যশিল্পে অনেক সুগন্ধযুক্ত রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার করা হয়। এসব যৌগ তৈরির জন্য বড় অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে রসায়নের অনেক গবেষকও (Fragrance chemist) কাজ করেন, গবেষণা করেন। নতুন নতুন যৌগ ডিজাইন ও তৈরি করেন। জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র এই শিল্পের দুনিয়ায় প্রতিনিধিত্ব করছে।
একটা বস্তুর রং কেন লাল বা নীল হয়, তা আমরা জানি। কারণ, লাল বা নীল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। মস্তিষ্ক সেটা প্রক্রিয়াজাত করে ভিন্ন ভিন্ন রঙের অনুভূতি তৈরি করে। রং মূলত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফলাফল। শব্দ বা সংগীতের বেলাতেও তা–ই। শব্দতরঙ্গের কম্পাঙ্কের ওপর ভিত্তি করেই আমরা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ পাই।
মানুষ সব সময়ই ভেবেছে, গন্ধের অনুভূতি কী করে হয়? বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, রাসায়নিক অণু যখন আমাদের নাকের ভেতর রিসেপ্টরের (Olfactory receptor) সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সেই কোষগুলো সক্রিয় বা অ্যাকটিভেট হয়। কোষ থেকে ইলেকট্রিক সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছায়, আমরা গন্ধ অনুভব করি। এ–বিষয়ক কাজের জন্য বিজ্ঞানী লিন্ডা বাক ও রিচার্ড এক্সেল ২০০৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। তবে এ–ও সত্য যে এ–সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে এখনো আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। পুরো বিষয় এত জটিল যে অনেক গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রশ্নের উত্তর আমরা আজও পাইনি। যেমন গন্ধের এই যে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি—কোনোটা ফুলের মতো, কোনোটা সেঁদো, কোনোটা ফলের মতো—এই অনুভূতির সৃষ্টি ও পার্থক্য কী করে হয়, তা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা এখনো বিজ্ঞানীদের নেই। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষ প্রায় এক ট্রিলিয়ন ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ অনুভব করতে পারে। আর প্রায় ৪০ বিলিয়ন অণু গন্ধযুক্ত হতে পারে। বিষয়টা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, তবে এখনো অনেক ধাঁধা রয়ে গেছে।
রাসায়নিক অণুর গঠনের কারণে গন্ধের ভিন্নতা হয়, তা আমরা জানি। কিন্তু রাসায়নিক অণু তো রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেখান থেকে কী করে গন্ধের এই ভিন্নতা হয়, তা আমরা এখনো ভালো করে জানি না। আরেকটা জটিল বিষয় হলো, অনেক রাসায়নিক অণু গঠনে ভিন্ন হলেও গন্ধের অনুভূতি একই। এটা কেন হয়, সেটাও এক রহস্য।
কস্তুরির কথা হয়তো অনেকে শুনেছেন। একটা বিশেষ প্রজাতির হরিণের শরীরে একটা গ্রন্থি থাকে, যেটাকে বলা হয় কস্তুর বা কস্তুরি (musk)। আর সেই গ্রন্থিতে থাকে একটা গন্ধযুক্ত রাসায়নিক যৌগ, মাসকন (muscon)। এসব যৌগকে মাস্ক যৌগও (Musk compound) বলা হয়।
মোগল বাদশাহরা হিমালয় পর্বতের পাদদেশ থেকে এই হরিণ মেরে কস্তুরি সংগ্রহ করতেন। তারপর সুবাস সংগ্রহ করে ব্যবহার করতেন। আমাদের সাহিত্যেও কস্তুরির কথা পাওয়া যায়। এই ভারতীয় প্রজাতির হরিণ থেকে কস্তুরি সংগ্রহ করে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা তাদের দেশে নিয়ে গেছে একসময়। ফ্রান্স অনেক আগে থেকে পারফিউমশিল্পের জন্য নামকরা। আজও সেই খ্যাতি ধরে রেখেছে তারা। হরিণ মেরে কস্তুরি সংগ্রহ করা যেহেতু বাস্তবিক কাজ নয় (কারণ, একসময় সব হরিণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে), তাই ইউরোপীয় রসায়নবিজ্ঞানীরা এই যৌগের রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করেছেন। তারপর সেই যৌগ গবেষণাগারে তৈরি করেছেন। এটাকে আমরা বলি সিনথেটিক কেমেস্ট্রি। রসায়নবিদেরা অনুরূপ আরও যৌগ তৈরি করেছেন, এমনকি গঠনে ভিন্ন অণু তৈরি করে দেখেছেন, কস্তুরির মতো গন্ধ পাওয়া যায়। পারফিউমশিল্পে এই মাস্ক যৌগগুলোর খুব চাহিদা।
গন্ধ আমাদের স্মৃতির সঙ্গেও যুক্ত। একজন মানুষ তার মস্তিষ্কে নানা ধরনের গন্ধ সংগ্রহ করে রাখতে পারে। গন্ধ দিয়ে আমরা অনেক কিছু শনাক্ত করি। জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও গন্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বহু পোকামাকড় ও প্রাণী বিভিন্ন গন্ধ নিঃসৃত করে বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করে। প্রাণীদের শরীর থেকে নিঃসৃত এই গন্ধযুক্ত যৌগকে আমরা বলি ফেরোমন (pheromone)। আবার ফুল, ফল, উদ্ভিদ থেকে যেসব গন্ধযুক্ত রাসায়নিক যৌগ পাই, সেগুলোকে বলা হয় নির্যাস তেল (Essential oil)। গন্ধযুক্ত অনেক রাসায়নিক যৌগ উদ্ভিদ তৈরি করে পোকামাকড় থেকে নিজেদের বাঁচাতে। প্রকৃতির আত্মরক্ষার কৌশল এটা। অনেক সময় বলা হয়, চালে যদি লবঙ্গ দিয়ে রাখা হয়, তাহলে চালে পোকা হয় না। কেন হয় না? কারণ, লবঙ্গের মধ্যে যে প্রধান রাসায়নিক যৌগ ইউগিনল থাকে, সেটা পোকামাকড়কে দূরে রাখে। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই শরীরে বিভিন্ন তেল ব্যবহার করেন। সেসব তেল মূলত উদ্ভিদ থেকে সংগৃহীত সুগন্ধি—রাসায়নিক অণু। এসব অণু মশা-মাছিকে মারে না, কিন্তু দূরে রাখে। আবার এসব রাসায়নিক যৌগ শরীরে ব্যবহারের উপকারিতা হলো, আমাদের জন্য এগুলো ক্ষতিকর নয়। যেসব পোকামাকড়নাশক মশা-মাছিকে মারে, সেগুলো আমাদেরও কিছুটা ক্ষতি করে। ফলে ইনসেক্ট কিলারের চেয়ে ইনসেক্ট রিপিলেন্ট এখন অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
গন্ধযুক্ত অনেক রাসায়নিক অণু চিকিৎসাক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যারোমা থেরাপির কথা নিশ্চয় অনেকে শুনেছেন। অ্যারোমা থেরাপির জন্য সুগন্ধযুক্ত রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার করা হয়। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার জন্য, ব্যথার জন্য অ্যারোমাথেরাপি জনপ্রিয়।
রাসায়নিক অণু কী করে আমাদের মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন গন্ধের অনুভূতি জোগায়? কী করে নতুন নতুন রাসায়নিক যৌগ তৈরি করার আগেই সেটার গন্ধ সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারব? এমন বহু প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হচ্ছে বর্তমানে। জিপিএস দিয়ে যেমন আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাই, নেভিগেট করি, তেমনি রাসায়নিক অণুদের নিয়ে যদি একটা গন্ধের ম্যাপ থাকে, তাহলে আমরা অণুতে অণুতে নেভিগেট করতে পারবে। আরও মজার বিষয় হলো, আমরা গান বা একটা রঙের ইমোজি টেক্সট করতে পারি। একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারি। কিন্তু গন্ধ তো পাঠিয়ে দিতে পারি না। গন্ধ কি টেক্সট করা যায়? অনেকেই এমন প্রশ্ন করছেন। এই ডিজিটাল যুগে গন্ধ কেন টেক্সট করা যাবে না? এ জন্যও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ হচ্ছে। খুব মজার একটা ভাবনা, তাই না? একদিন হয়তো আমরা গন্ধও টেক্সট করতে পারব। তেমনটাই ভাবছেন অনেক গবেষক।
লেখক: গবেষক ও লেখক
* লেখাটি সম্প্রতি অসমো এআই (Osmo AI) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে দেওয়া লেখকের লেকচারের ভাবানুবাদ
*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত