সাজসজ্জায় রসায়ন

সাজসজ্জায় প্রসাধনীর ব্যবহার শুরু হয় প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার হাত ধরেই। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সূচনা ঘটে এই যাত্রার। রানি ক্লিওপেট্রা বিশেষ ‘স্মোকি আই’ মেকআপে অলংকারে ব্যবহৃত মালাকাইট ও লাজিউলাই নামের নীল ও সবুজ পাথরের গুঁড়া ব্যবহার করতেন। তবে প্রাচীন মিসরীয়রা শুধু তাদের সৌন্দর্য বাড়াতে মেকআপের ব্যবহার করত বললে ভুল হবে। রোগমুক্তি এবং নানা গুরুত্বপূর্ণ কারণে দেবতা হোরাস ও রা-এর সন্তুষ্টি লাভের জন্যও মেকআপ ব্যবহার করত প্রাচীন মিসরীয়রা।

ফারাওয়ের শাসনকাল থেকে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে নানা পরিবর্তন এসেছে সাজসজ্জা ও রূপচর্চায় প্রসাধনীর ব্যবহারে। প্রাচীন গ্রিকদের মুখমণ্ডলে নানা রকম চিত্রাঙ্কন, বাইজেন্টাইন সভ্যতায় নানা রঙে চুল রাঙানোর চল ছিল। বর্তমান যুগে মধ্যবয়সীদের ত্বকে মেছতাসহ নানা রকম দাগ দূর করতে মেকআপ ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ সব যুগেই মেকআপ সাজসজ্জায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

আগে মেকআপ মানেই ছিল ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি পণ্য। তবে কয়েক শতাব্দী ধরে সাজসজ্জার জন্য প্রসাধনসামগ্রী সারা বিশ্বে বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন প্রাচীন রোমান সভ্যতায় গাল রাঙানোর জন্য বিষাক্ত পারদ ব্যবহার করা হতো। সাদা সিসাকে মেকআপের ফাউন্ডেশন হিসেবে ব্যবহার করতেন রানি প্রথম এলিজাবেথ।

ধারণা করা হয়, ১৯২০ সালের আগপর্যন্ত ‘মেকআপ’ শব্দটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবহারের চল ছিল না। প্রসাধনসামগ্রীর জগতের গুরুত্বপূর্ণ ব্র্যান্ড ম্যাক্স ফ্যাক্টরের সোসাইটি মেকআপ নামের পণ্যটি চালু করার পর থেকে প্রথম এই শব্দ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই থেকে শুরু। এর পর থেকে মেকআপের জগতে এসেছে বৈচিত্র্য, বেড়েছে এর জনপ্রিয়তা। শুধু তা-ই নয়, আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছে এই প্রসাধনশিল্প। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই শিল্পের বাজারমূল্য হবে প্রায় ৭৫৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

সময়ের সঙ্গে সাজসজ্জার পাশাপাশি মেকআপে এসেছে পরিবর্তন, সেই সঙ্গে এসেছে এর উপকরণেও। ফলে একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে নতুন ধাঁচের পণ্য, তেমনি পুরোনো পণ্য বাজারে ফিরছে নতুন রূপে। আবার কিছু কিছু হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে। এর মধ্যেও বছরের পর বছর টিকে আছে লিপস্টিক নামের প্রসাধনী। যুগে যুগে মানানসই রং, সময়োপযোগী স্টাইল ও ব্যবহারের দিক থেকে এতে এসেছে নানা পরিবর্তন।

কিছু কিছু ব্র্যান্ড আবার লিপস্টিকে নতুনত্ব আনতে এতে জুড়ে দিয়েছে বিজ্ঞান। কয়েক বছর আগে বাজারে দেখা মিলেছিল স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট লিপস্টিকের। ব্যবহারের পর অনেকটা জাদুর মতো এটি বদলে দিত ঠোঁটের রং। তবে রেড-২৭ নামের একটি উপকরণই স্বচ্ছ লিপস্টিকের রং বদলের জন্য দায়ী। এটি অনেকটা লিটমাস কাগজের মতো রং বদলকারী রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে কাজ করে। রেড-২৭ ত্বকের আর্দ্রতা ও পিএইচের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ত্বকের রঙের ওপর ভিত্তি করে রঙের বদল করে।

কী কী আছে লিপস্টিকে?

লিপস্টিক প্রসাধনসামগ্রীর জগতে এত জনপ্রিয় কেন? কী আছে এতে, চলুন জেনে নেওয়া যাক।

তেল: লিপস্টিকের ৬৫ শতাংশ হলো ক্যাস্টর অয়েলের মতো তেল। এই তেল ঠোঁটের জন্য ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। ঠোঁটের জীবাণু ঠেকাতেও তেলের ভূমিকা রয়েছে।

মোম: লিপস্টিকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে মোম। লিপস্টিক তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের মোম ব্যবহার করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় কারনুবা নামের ব্রাজিলিয়ান মোম ও মৌচাকের মোম। কোপারনিসিয়া প্রুনিফেরা নামের একধরনের পামগাছ থেকে কারনুবা মোম পাওয়া যায়। একটি লিপস্টিকে মোমের পরিমাণ থাকে ২৫ শতাংশ।

ল্যানোলিন: ভেড়ার গায়ের ছেঁটে ফেলা লোম থেকে পাওয়া যায় এই বিশেষ ধরনের মোম। মূলত উলের তন্তু থেকে উল সরিয়ে নিয়ে এটি আলাদা করা হয়। ভেড়ার গায়ের লোম ছাড়াতে এটি অনেকটা পিচ্ছিলকারী পদার্থের মতো কাজ করে। যেমনটা মানবদেহে তেল ব্যবহারে দেখা যায়। গোটা লিপস্টিকের ৫ শতাংশ হলো এই ল্যানোলিন। ময়েশ্চারাইজার ছাড়াও লিপস্টিকে আঠালো ভাব আনতে সাহায্য করে এটি।

রং: একটি লিপস্টিককে আকর্ষণীয় করে তোলে এর রং। লিপস্টিকের ৫ শতাংশই হলো রং। প্রসাধনীর সারি সারি অসংখ্য লিপস্টিকের শেড সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়। এসব শেড তৈরিতে ব্যবহার করা হয় অসংখ্য রং। টকটকে লাল লিপস্টিকে থাকে কারমিন নামের গাঢ় লাল রঙা একধরনের রঞ্জক পদার্থ। এটা পোকামাকড় চূর্ণ করে তৈরি করা হয়।

ক্যাপসাইসিন: উপাদানটি সব লিপস্টিকে থাকে না। ক্যাপসাইসিনের ‘প্লাম্পিং’ নামের বিশেষ ক্ষমতার কারণে কিছু কিছু লিপস্টিকে থাকে এটা। এর ঝাঁজালো বৈশিষ্ট্য ঠোঁটকে ফোলাতে কিংবা প্লাম্প করে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করে।

আপনি জানেন কি?

খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে চীনে প্রথম নেইল পলিশের ব্যবহার শুরু হয়।

ত্বক অনুযায়ী ফাউন্ডেশনের রং বদলাতে আয়রন অক্সাইডের মতো রঞ্জক পদার্থগুলোর ব্যবহার

করা হয়।

বিশ্বে আবিষ্কৃত প্রথম ৫ প্রসাধনসামগ্রী

লিপস্টিক: ১৮৮৪ সালে ফ্রান্সের প্রসাধনী ব্র্যান্ড গুয়েরলিন বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে প্রথম লিপস্টিক বিক্রি করে। এটি তৈরিতে তারা হরিণের চর্বি, মৌচাক থেকে সংগ্রহ করা মোম ও ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করে। পরে সিল্কের কাগজে মুড়িয়ে তা বাজারে আনা হয়।

মাসকারা: বোনম্যাবেলকে বোতলের ছিপি পুড়িয়ে, তা পেট্রোলিয়াম জেলির সঙ্গে মিশিয়ে সেটি ভ্রু ও চোখের পাপড়িতে লাগানোর প্রচলন ছিল আগে। এটি দেখে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড মেবেলিনের প্রতিষ্ঠাতা টমাস উইলিয়ামস ১৯১৭ সালে প্রথম রঙিন মাসকারা তৈরি করেন। সেটার নাম ছিল ল্যাশ-ব্রো-আইন।

নেইল পলিশ: বিখ্যাত প্রসাধনসামগ্রীর কোম্পানি রেভলনের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস ও জোসেফ রেভসন ১৯৩২ সালে প্রথম নেইল পলিশ তৈরি করেন। একধরনের অস্বচ্ছ অ্যানামেলকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিক্রি করেন তাঁরা। পরে এ দুই ভাই মাইকেল মেনার্ডকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ির রঙে ব্যবহৃত অ্যানামেল ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়ে নেইল পলিশ তৈরি করেন।

ফাউন্ডেশন: ১৯৩৮ সালে ম্যাক্স ফ্যাক্টর একধরনের প্রেসড পাউডার তৈরি করেন। সেটা বাজারে পেন-কেক নামে জনপ্রিয়তা পায়। তবে এর আগে অভিনয়শিল্পীরা তাঁদের মাথার পরচুলার সঙ্গে ত্বকের রং মেলাতে গ্রিসপেইন্ট ব্যবহার করতেন।

কনসিলার: ১৯৫৪ সালে প্রথম কনসিলার স্টিক বাজারে এনে ম্যাক্স ফ্যাক্টর আরও একবার ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখে। ইরেস নামের সাদা রঙের এই কনসিলারের মাধ্যমে চেহারার দাগ ও বলিরেখা সহজেই ঢেকে ফেলা সম্ভব।