টেকনিশিয়ামের খোঁজে

১৯৩৭ সাল। ইতালির সিসিলিতে পালের্মো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছাল মলিবডেনাম ধাতুর একটা প্লেট। এসেছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কেলে থেকে। বিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্সের অ্যাটম স্ম্যাশার নামের ৩৭ ইঞ্চির কণা ত্বরক যন্ত্রে এই আবিষ্কার ছিল রসায়নের জগতের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি।

৪৩তম মৌলটি ছিল দিমিত্রি মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণির ফাঁকা জায়গাতে। এর ধর্ম অনেকটা ম্যাঙ্গানিজের মতো হবে বলে একা-ম্যাঙ্গানিজ বলা হতো। দিমিত্রি মেন্ডেলিভ প্রথম মৌলগুলোকে পারমাণবিক ভরের অনুসারে এবং অন্য মৌলের সঙ্গে আচরণের মিলের দিক দিয়ে সাজিয়ে তার পর্যায় সারণিটি তৈরি করেন। কিন্তু এটা করতে গিয়ে অনেক অনাবিষ্কৃত মৌলের জন্য জায়গা ফাঁকা রাখতে হয়। ধীরে ধীরে মেন্ডেলিভের ভবিষ্যদ্বাণীমতো মৌলরা ফাঁকা জায়গাতে বসে গেলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত ৪৩তম স্থানটি ফাঁকাই রয়ে যায়।

সে সময় ইতালির পালের্মো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন ৩২ বছরের তরুণ বিজ্ঞানী এমিলো সেগ্রেই। এর আগে কাজ করেছেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির সঙ্গে। সীমিত বাজেট, মান্ধাতার আমলের হাতে তৈরি যন্ত্র নিয়েই ফার্মির দল মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণিতে নতুন নতুন অংশ জুড়েছেন।

এদিকে ফ্রান্সে ফ্রেডরিখ ও আইরিন জুলিও কুরি দেখান যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে একটা মৌল আরেকটা মৌলে পরিণত হতে পারে। মাদাম কুরি ও পিয়েরে কুরির সন্তান আইরিন কুরি। তিনি স্বামী ফ্রেডরিখ জুলিও কুরির সঙ্গে ১৯৩৫ সালে এই আবিষ্কারের জন্যই রসায়নে নোবেল পান। সেগ্রেই মনে করলেন, লরেন্স হয়তো তাঁর অজান্তেই কণা ত্বরক যন্ত্রে নতুন মৌলটি তৈরি করেছেন। লরেন্স মলিবডেনাম ব্যবহার করছিলেন, এর পারমাণবিক সংখ্যা হলো ৪২। যদি একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস এটাকে আঘাত করে এর সঙ্গে মিশে যায়, তবেই পাওয়া যাবে ৪৩তম মৌলটি। সেগ্রেইয়ের ধারণা, লরেন্স তাঁর ত্বরক যন্ত্রে হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ডিউটোরিয়াম দিয়ে ক্রমাগত মলিবডেনামে আঘাত করেছেন। তার ফলেই হয়তো মলিবডেনাম প্লেটে অল্প কিছু একা-ম্যাঙ্গানিজ তৈরি হয়েছে। সেগ্রেই লরেন্সের কাছে কাছে আরও কিছু নমুনা চেয়ে চিঠি লিখলেন। লরেন্সের কাছে ম্যাঙ্গানিজের কিছু পাত অবশিষ্ট ছিল, সেগুলোই তিনি খুশিমনে পাঠিয়ে দিলেন।

সহকর্মী কার্লো পেরিয়ারের সঙ্গে সেগ্রেই সেই পাতের রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করলেন। সোডিয়াম পার–অক্সাইড এবং হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের সঙ্গে স্যাম্পল ফুটিয়ে অবশেষে ৪৩ নম্বর মৌল বের করা সম্ভব হলো। ৪৩ নম্বর মৌল একা-ম্যাঙ্গানিজের অর্ধায়ু কয়েক মিলিয়ন বছর। অথচ পৃথিবীর বয়স মোটামুটি ৫ বিলিয়ন বছর। তাই পৃথিবীর শুরুতে কোনো একা-ম্যাঙ্গানিজ যদি তৈরিও হয়, সেগুলোর প্রায় সবটুকু এখন তেজস্ক্রিয় ভাঙনে অন্য মৌলে পরিণত হয়েছে। এ জন্যই প্রাকৃতিকভাবে এই মৌল পাওয়া যায় না। এই আবিষ্কারের ১০ বছর পর ১৯৪৭ সালে একা-ম্যাঙ্গানিজের নাম দেওয়া হয় টেকনিশিয়াম। গ্রিক শব্দ টেকনোস থেকে এসেছে নামটি। টেকনাস অর্থ কৃত্রিম। তত দিনে মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণির বাকি ফাঁকা স্থানগুলোও পূরণ হয়ে গেছে। সেগ্রেই পরে ৮৫ নম্বর মৌল অ্যাস্টাটিন আবিষ্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

এই আবিষ্কারই ছিল যুগান্তকারী এবং ভারী মৌল আবিষ্কারের পথপ্রদর্শক। ১৯৩৯ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী এডুইন ম্যাকমিলান বার্কলে রেডিয়েশন ল্যাবে ৯৩তম মৌল নেপচুনিয়াম তৈরি করেন। ১৯৪১–এর ফেব্রুয়ারিতে গ্লেন সিবর্গ ৯৪তম মৌল তৈরি করেন গবেষণাগারে। সেগ্রেইয়ের সহায়তায় সিবর্গ প্রমাণ করেন, তাঁর এই আবিষ্কার আসলে প্লুটোনিয়াম, যা পারমাণবিক বোমায় ব্যবহার করা যাবে। সিবর্গ আরও নয়টা মৌল কৃত্রিমভাবে তৈরি করেন। তাঁর সম্মানে ১০৬তম মৌলের নাম দেওয়া হয় সিবর্গিয়াম।

টেকনিশিয়াম আবিষ্কারের পথ ধরে আজ পর্যায় সারণি ১১৮তম মৌল ওগানেসন পর্যন্ত পৌঁছেছে। নতুন এই মৌলগুলো এমন সব কাজে লাগছে, যা তখন কেউ কল্পনাও করেনি। ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র, মহাকাশযানের জ্বালানি থেকে শুরু করে ভয়ংকর অস্ত্র পর্যন্ত।

তবে তর্কযোগ্যভাবে সেরা আবিষ্কারটার খেতাব টেকনিশিয়াম আর তার ছয় ঘণ্টা অর্ধায়ুর আইসোটোপটাই পায়। এই আইসোটোপটা সেগ্রেই এবং সিবর্গ মিলে তৈরি করেন। বিশ্বের নিউক্লিয়ার মেডিসিনে ব্যবহৃত উপাদানের ৮০ শতাংশই হলো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ টেকনিশিয়াম।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কোরিয়া অ্যাডভান্স ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি

সূত্র: নেচার