ভেপ: মৃত্যুর ‘মিষ্টি’ স্বাদ

অনেকে ধূমপানের বিপরীতে ভেপ বেছে নেন। অনেকে ভেপ নেন অকারণে। কেউ কেউ হয়তো ভাবেন, এটি ক্ষতিকর নয়। এগুলো ভুল ধারণা। ভেপের স্বাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি…

‘যেদিন ধূমপানের ক্ষতির কথা পড়লাম, সেদিন থেকে পড়াই ছেড়ে দিয়েছি।’ পুরোনো কৌতুক। তবে প্রাসঙ্গিক। আপনি যদি ভেপ নিয়ে থাকেন, হোক নিয়মিত বা অনিয়মিত, তবে এই লেখা হয়তো এখনই পড়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত! না না, সত্যি সত্যি এ কাজ করবেন না। ভেপের ক্ষতি ও ঝুঁকির বিষয়গুলো জানা গুরুত্বপূর্ণ।

ভেপ জিনিসটা এত দিন ধূমপানের মতো বহুল প্রচলিত ছিল না। কেউ কেউ আয়েশ করে, কেউ হয়তো খানিকটা ভাব নিতে কিংবা ধূমপানের ‘অ-ক্ষতিকর’ বিকল্প হিসেবেই হয়তো বেছে নিতেন ভেপ। তবে সম্প্রতি এই প্রবণতা বাড়ছে দ্রুত। অবশেষে তাই এর ক্ষতির বিষয়গুলোও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা রীতিমতো খুঁটিয়ে গবেষণা করেছেন।

এখানে দুটি বিষয় বলা প্রয়োজন। এক, চলতি নাম ভেপ হলেও এর পোশাকি নাম ‘ই-সিগারেট’। দুই, হয়তো ভাবছেন, এ জিনিস কেউ খায় নাকি? হতে পারে, অনেকের পরিচিতদের মধ্যে ভেপের চিহ্নও নেই। তবে দেশ-বিদেশে কোথাওই ভেপকে অবহেলা করার সুযোগ নেই আর। নিউ সায়েন্টিস্ট-এর তথ্য বলছে, ইংল্যান্ডে বর্তমানে ৪৫ লাখ নিয়মিত-অনিয়মিত ভেপার আছেন। এটি দেশটির জনসংখ্যার ৭.৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার তরুণদের মধ্যে বাড়ছে রকেটের গতিতে। ২০১৯ সালে কলেজশিক্ষার্থীদের মধ্যে ভেপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ—২৭.৫ শতাংশ। ওদিকে যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে ১১-১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ভেপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫০ শতাংশের মতো! অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ ও যুক্তরাজ্যে ২১ বছরের কম বয়সীদের কাছে ভেপ বিক্রি নিষিদ্ধ।

ভেপ সিগারেটের মতোই ক্ষতিকর

বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের তথ্য পাওয়া কঠিন। প্রথম আলো সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘ইলেকট্রনিক সিগারেটস (ভেপিং) প্রেফারেন্সেস অ্যামং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৩১.২৭ শতাংশ ই-সিগারেট সেবন বা ভেপিংয়ে অভ্যস্ত, অথবা জীবনে একবার হলেও ই-সিগারেট পান করেছেন।

দেশের সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া চার শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণাটি করা হয়েছিল। দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ ই-সিগারেট সেবনের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে কিছু জানেন না। আর ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ বলছেন, ই-সিগারেট তাঁদের তামাকে আসক্ত করে ফেলেছে।

এ থেকে হয়তো ভেপ সেবনের চিত্রটা সম্পর্কে পাঠক একটা ধারণা পাবেন।

ডিজাইনে ভিন্নতা দেখা যায়, তবে সব ভেপেই সাধারণ কিছু জিনিস থাকে। যেমন একটা ট্যাংকে থাকে ‘ই-লিকুইড’ বা ভেপের ‘জুস’। একটা ‘হিটিং এলিমেন্ট’ থাকে, তপ্ত হয়ে ওঠে। এটি তরল ‘জুস’কে তাপ দিয়ে বাষ্পীভূত করে ফেলে। ঠিক বাষ্প নয়, কণাগুলো এ মিশ্রণে ভেসে বেড়ায়, দ্রবীভূত হয় না। আর গ্যাসের মধ্যে কিছু ছোট ছোট তরলের ফোঁটা থাকে। রসায়নের ভাষায় একে বলে সাসপেনশন। মাউথপিস দিয়ে এই মিশ্রণ—আপাতত বাষ্পই বলা যাক—টেনে নেন গ্রাহক।

জুসের মধ্যে সাধারণত থাকে নিকোটিন আর ফ্লেভার বা স্বাদ। সঙ্গে একটি দ্রাবক—এটাই সাসপেনশনের বড় অংশজুড়ে থাকে। এটিই বাষ্পীভূত জুসকে বয়ে নেয় ফুসফুসে। অন্যতম বহুল ব্যবহৃত দ্রাবক হলো প্রোপিলিন গ্লিসারল ও গ্লিসারিন।

স্বাদের জন্য ভেপ নিতে হয়তো মজা লাগে। তবে এর উপাদানগুলোর সব কটিই যে ক্ষতিকর, সে ব্যাপারে এখন নিশ্চিত গবেষকেরা। যেমন নিকোটিন। তামাকে যে নিকোটিন থাকে, তা হয়তো অনেকেই জানেন। এটি নেশাজাতীয় দ্রব্য। এর ফলে স্নায়ু দ্রুত উত্তেজিত হয়, ফলে দ্রুত স্পন্দিত হয় হৃৎপিণ্ড। তখন দ্রুত ও তীব্রভাবে দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়, ফলে বেড়ে যায় ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ। এর ফলে সরাসরি হার্ট অ্যাটাক হয় কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হৃৎপিণ্ড নিয়মিত হারে দ্রুত স্পন্দিত হলে অকেজো হয়ে পড়ে। এ তথ্য জানা গেছে গত বছরের জুলাইয়ের শেষে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে।

প্রোপিলিন গ্লিসারল ও গ্লিসারিন সরাসরি বিষাক্ত নয়। তবে নিয়মিত শ্বসনের মাধ্যমে টেনে নিলে কাশি হতে পারে, ধীরে ধীরে কমতে পারে ফুসফুসের ক্ষমতা। দীর্ঘদিন এভাবে গ্রহণ করলে বুকে ব্যথা হতে পারে।

বাজারে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরণের ভেপ, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ভেপের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক আছে কি না, এ গবেষণা করতে গিয়েও বিপদের ছায়াই পাওয়া গেছে। ৫৪ সপ্তাহ টানা কিছু ইঁদুরকে ভেপের বাষ্প দেওয়া হয়েছে।

স্বাদের জন্য দায়ী কিছু রাসায়নিক আবার সরাসরি বিষাক্ত। যেমন ডাইএসিটিল এবং এসিটিলপ্রোপিলিন। আর মেন্থল, কফি, স্ট্রবেরির মতো ফ্লেভারগুলোতে থাকা রাসায়নিকের জন্য কোষে জ্বালাপোড়া হতে পারে। মিষ্টির জন্য ব্যবহৃত সুক্রোজ ও গ্লুকোজ তাপে রিয়েকটিভ এলডিহাইডে পরিণত হয়। এ ধরনের জৈব যৌগ হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসকে অকেজো করে ফেলে দিন দিন। পাশাপাশি ভেপের বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয় নিকেল-ক্রোমিয়াম সংকরের মতো ভারী ধাতু। ইঁদুরে এগুলো প্রয়োগ করে দেখা গেছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে শ্বাসের সময়। কারখানা বা অন্যভাবে কাজের সূত্রে নিকেল ও ক্রোমিয়ামের যৌগ বেশি গ্রহণ করেছেন, এ রকম মানুষদের ফুসফুসে ক্যানসার বেশি হয়। আর এই নিকেলের জন্য তামাকের চেয়েও ভয়ংকর ভেপ। যত দিন যায়, ভারী ধাতু উৎপাদনের পরিমাণ তত বাড়ে। ১০১-১৫০তম বার টেনে নেওয়ার সময় ভারী ধাতু উৎপন্ন হয় প্রথম ৫০ টানের চেয়ে ৬০ গুণ বেশি। এগুলোর পাশাপাশি কার্বন মনোক্সাইড, বিভিন্ন ক্ষতিকর জৈব যৌগ তো আছেই।

ভেপের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক আছে কি না, এ গবেষণা করতে গিয়েও বিপদের ছায়াই পাওয়া গেছে। ৫৪ সপ্তাহ টানা কিছু ইঁদুরকে ভেপের বাষ্প দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে মূত্রথলি ও ফুসফুসের ক্যানসারের প্রবণতা বেশি। তবে ইঁদুরে হলেই যে মানুষেরও এ সমস্যা হবেই, সে বিষয়ে এখনো শতভাগ নিশ্চিত নন গবেষকেরা। এ নিয়ে গবেষণা চলছে।

ভেপের প্রত্যক্ষ ক্ষতি যেমন আছে, পরোক্ষ ক্ষতিও আছে। দেখা গেছে, ভেপ নেন, এমন ২৩ শতাংশ মানুষ পরে ধূমপান শুরু করেছেন। তবে অনেকে ধূমপান ছেড়ে ভেপে আসেন। এ রকম কিছু মানুষকে নিয়ে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় মাস ভেপ নেওয়ার পর তাঁরা ধীরে ধীরে ভেপ ও তামাকের মতো নেশাজাত দ্রব্য থেকে সরে এসেছেন। অর্থাৎ ভেপ ধূমপানের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়। তবে যাঁরা ছাড়তে চান, তাঁদের জন্য সহায়ক হতেও পারে। তবে এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এবং নিজেকে ‘ভেপই তো নিই, ধূমপান তো আর করি না’ ভেবে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। কারণ, মনে মনে খুশি থাকলেও ঠিকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপনার দেহ। দীর্ঘদিন ভেপ নিলে হয়তো এ ক্ষতি থেকে কখনোই আর সেরে উঠতে পারবেন না।

শেষের আগে

গণিত অলিম্পিয়াডে তিনটি শপথ করানো হয় শিক্ষার্থীদের। তিন ‘ম’-কে না বলা। ১. মিথ্যাকে না, ২. মাদককে না এবং তিন. মুখস্থকে না। এর সঙ্গে একটু যোগ করে বলা যায়, ধূমপান, তামাক, ভেপ বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর—এ রকম সবকিছুকেই না বলতে হবে।

এগুলো যে ক্ষতিকর, সে কথা কেউ জানেন না, এমন নয়। তবে জেনেও এড়িয়ে যাওয়াকে একধরনের ঘুমিয়ে থাকাই বলা যায়। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ‘খোকার সাধ’ কবিতাটির লাইনটি বলা যায়, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট, প্রথম আলো