রসায়নের শিক্ষার্থীদের কাছে নিষ্ক্রিয় গ্যাস বরাবরই বিশেষ আগ্রহের বিষয়। বেশিরভাগ রাসায়নিক বিক্রিয়াও ঘুরপাক খায় এইসব নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ধর্মকে কেন্দ্র করেই। তবে, পর্যায় সারণিতে এই নিষ্ক্রিয় গ্যাসের সংখ্যা মোটে সাতটি। এদের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস আছে। এই সাতটির মধ্যে হিলিয়াম হলো সবচেয়ে হালকা ও তালিকার দ্বিতীয় মৌল। হিলিয়ামের উৎপত্তির গল্পও বেশ আকর্ষণীয়। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরেই যে তিনটি মৌল সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে হিলিয়াম অন্যতম। মহাবিশ্বের জন্মের প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই এই মৌলের নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। চলুন তাহলে, হিলিয়াম মৌলের বিস্ময়কর কিছু তথ্য জানা যাক।
১. হাইড্রোজেনের পরে মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হিলিয়াম
মহাবিশ্বে যে কয়টি মৌল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, তার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হলো হিলিয়াম। মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৫ শতাংশ হিলিয়াম। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ রয়েছে হাইড্রোজেন। আর বাকি প্রায় ১ শতাংশ অন্যান্য সব মৌল দিয়ে গঠিত। তবে পৃথিবীতে হিলিয়াম কিছুটা বিরল। শুধু ভূপৃষ্ঠের গভীরে এটি পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থ লাখ লাখ বছর ধরে ধীরে ক্ষয় হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক হিলিয়াম গ্যাস তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৯৯ শতাংশেরও বেশি বিশুদ্ধ হিলিয়াম পাওয়া যায়। পৃথিবীতে এই গ্যাস বেশি পাওয়া না গেলেও মহাবিশ্বে অভাব নেই।
২. হিলিয়াম বাতাসের থেকে হালকা
হিলিয়াম বাতাসের তুলনায় অনেক হালকা। এজন্য গ্যাস বেলুনে ব্যবহার করা হয় হিলিয়াম। গ্যাস বেলুন বানাতে দরকার বাতাসের চেয়ে হালকা গ্যাস। কিন্তু হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা হলেও অতি দাহ্য। তাছাড়া বাতাসের সংস্পর্শে এলে খুব সহজেই আগুন ধরে যায়। তাই গ্যাস বেলুনে হিলিয়াম ব্যবহার করা হয়।
৩. প্রথম হিলিয়াম আবিষ্কার
পৃথিবীতে হিলিয়াম আবিষ্কৃত হওয়ার আগে এই মৌলের প্রথম সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল সূর্যে। ১৮৬৮ সালের সূর্যগ্রহণের সময় ফরাসি জ্যোতির্বিদ পিয়ের জ্যানসেন সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার স্তরে একটি নতুন ও উজ্জ্বল হলুদ রেখা দেখতে পান। তখন তিনি এই রেখাটিকে একটি অজানা উপাদানের বৈশিষ্ট্য বলে বলে জানান। কিন্তু প্রথম হিলিয়াম আলাদা করেন স্কটিশ বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম রামসে, ১৮৯৫ সালে। তিনি ইউরেনিয়ামের আকরিক ক্লেভাইটকে অম্লের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন দূর করেন। এরপর বর্ণালি নিয়ে দেখতে পান, তিন যুগ আগে পাওয়া সেই হলুদ রেখা।
সে বছরই সুইডিশ বিজ্ঞানী পার টিওডর ক্লিভ ও আব্রাহাম ল্যাংলেট স্বাধীনভাবে হিলিয়াম আলাদা করে পারমাণবিক ভরও বের করেন। ফরাসি জ্যোতির্বিদ পিয়ের জ্যানসেন ছাড়াও নরম্যান লকইয়ার দেখতে পান সেই সৌর বর্ণালিতে হলুদ রেখা। তিনি এটিকে একটি ধাতু বলে ধারণা করেছিলেন। দুজনে আলাদাভাবে কাজ করলেও হিলিয়াম আবিষ্কারের কৃতিত্ব দুজনকেই দেওয়া হয়। নরম্যান লকইয়ার ছিলেন বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচার-এর প্রথম সম্পাদক। হিলিয়াম (Helium) নামটা দিয়েছেন লকিয়ার এবং ব্রিটিশ রসায়নবিদ অ্যাডওয়ার্ড ফ্রাকল্যান। গ্রিক পুরাণের সূর্য দেবতা হিলিয়াসের (Helios) নামানুসারে এমন নাম দেওয়া হয়েছে।
৪. হিলিয়ামের শীতল করার ক্ষমতা
হিলিয়ামের শীতল করার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। এর পারমাণবিক ভর কম এবং আন্তঃপারমাণবিক আকর্ষণ দুর্বল। এ মৌল খুব কম তাপমাত্রায় তরল ও সুপার ফ্লুইড পরিণত হতে পারে। প্রায় মাইনাস ২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি তরল হয় মাইনাস ২৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে পরিণত হয় সুপার ফ্লুইডে। তখন এর ওপর ঘর্ষণ বল আর কাজ করে না। ফলে হিলিয়াম হয়ে যায় অতিপরিবাহী। এ অবস্থায় এর মধ্য দিয়ে তাপ বা বিদ্যুৎ চলতে বাধা পায় না। হিলিয়ামের এই শীতল করার ক্ষমতার জন্য এমআরআই (MRI) মেশিন ও রকেট ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয়।
৫. হিলিয়ামের প্রতিকণা
২০১১ সালে এক পরীক্ষা থেকে পাওয়া গেছে অ্যান্টিহিলিয়াম। অর্থাৎ, হিলিয়ামের প্রতিকণা। মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিকণাকে পেতে প্রায় আলোর গতিতে আয়নিত স্বর্ণকণার সংঘর্ষ ঘটাতে হয়। ফলে বেরিয়ে আসে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কণা। তার মধ্যেই পাওয়া গেছে হিলিয়ামের প্রতিকণা। ভবিষ্যতে হয়তো হিলিয়াম নিয়ে আরও নানারকম গবেষণা হবে। তখন হিলিয়ামের ব্যবহার আরও বাড়তে পারে।
৬. গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে হিলিয়ামের ব্যবহার
হিলিয়াম বিষাক্ত নয়। গভীর সমুদ্রের ডুবুরিরা দীর্ঘ সময় ধরে পানির নিচে থাকার পর যখন দ্রুত ওপরে উঠে আসেন, তখন ডিকম্প্রেশন সিকনেস এড়াতে হিলিয়াম মিশ্রিত একটি বিশেষ গ্যাস ব্যবহার করেন। দ্রুত চাপের পরিবর্তনের কারণে রক্তে গ্যাসের পরিমাণ যাতে না বেড়ে যায়, তা প্রতিরোধে সাহায্য করে এ মিশ্রণ। অন্য গ্যাসের তুলনায় হিলিয়াম শরীরে কম দ্রবীভূত হয়। তাই ডুবুরিদের নিরাপদে ওপরে উঠতে এই গ্যাস সাহায্য করে।
৭. হিলিয়াম মুখে নিলে কন্ঠস্বর অদ্ভূত শোনায়
গ্যাস বেলুন থেকে হিলিয়াম গ্যাস মুখে নিয়ে শ্বাস নিলে কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের (UNSW) জীবপদার্থবিদ জন স্মিথ বলেন, ‘আমাদের স্বরযন্ত্রের ভোকাল ফোল্ড বা কর্ড নামে দুটি ছোট পেশির দ্রুত কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরি হয়। স্বরযন্ত্রের এই পেশির ভাঁজগুলোর দ্রুত ওঠানামার কারণে ফুসফুস থেকে আসা বাতাসের প্রবাহ বাধা পায়। এতে কণ্ঠস্বর বদলে যায়।
যদি ভোকাল ফোল্ডগুলো প্রতি সেকেন্ডে ১০০ বার সামনে-পেছনে কম্পিত হয়, তাহলে সেগুলো প্রতি সেকেন্ডে ১০০ হার্জ (Hz) কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে। হিলিয়াম কণ্ঠনালীর এই ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে দেয় কিছু সময়ের জন্য। তখন কণ্ঠস্বর অদ্ভূত শোনায়। হিলিয়াম বাতাসের চেয়ে হালকা হওয়ায় শব্দের চেয়ে দ্রুত চলে। ফলে কণ্ঠস্বরের অদ্ভূত শোনায়।