পরমাণু আসে কোথা থেকে

পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, ‘যদি তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাত্র একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য রেখে যেতে চান, সেটি হবে ‘সবকিছুই পরমাণু দিয়ে তৈরি।’ কিন্তু এই পরমাণু কীভাবে তৈরি হলো? পরমাণু আসলে কী?

একটি পরমাণুর মাঝে থাকে নিউক্লিয়াস। এর মধ্যে আবার থাকে প্রোটন (ধনাত্মক চার্জ) এবং নিউট্রন (চার্জ নেই)। এর চারপাশে ঘোরে ইলেকট্রন (ঋণাত্মক চার্জ)। প্রতিটি পরমাণুতে যতগুলো প্রোটন থাকে, ঠিক ততগুলো ইলেকট্রন এর বাইরে ঘোরে। তাই পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ।

পৃথিবীতে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন ও অক্সিজেনের মতো অনেক পরমাণু আছে। কিন্তু মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন থাকে। এর কোনো নিউট্রন নেই। হিলিয়ামের আছে দুটি প্রোটন, দুটি নিউট্রন ও দুটি ইলেকট্রন। একই প্রোটনসংখ্যার পরমাণুগুলোর সমষ্টিকে বলে উপাদান বা মৌল।

যদি তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাত্র একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য রেখে যেতে চান, সেটি হবে ‘সবকিছুই পরমাণু দিয়ে তৈরি।'
রিচার্ড ফাইনম্যান, পদার্থবিজ্ঞানী

ভাবতে পারেন, প্রথম পরমাণু কখন তৈরি হলো? প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের শুরু। তার প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর মহাবিশ্ব শীতল হতে হতে নিউক্লিওসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় প্রথম হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হয়।

বিগ ব্যাংয়ের পর মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে। শুরুর দিকে এটি ছিল ছোট এবং অতি উত্তপ্ত। তখন ইলেকট্রনের এত শক্তি ছিল যে ওগুলো দিগবিদিক ছোটাছুটি করছিল। নিউক্লিয়াসের চারপাশে আটকাতে পারেনি। কিন্তু যখন তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে গেলে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের সঙ্গে জোড় বেধে এর চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। এভাবেই তৈরি হয় পরমাণু। এ প্রক্রিয়াকে বলে ‘রিকম্বিনেশন’।

হিলিয়াম এবং ডিউটেরিয়ামের (হাইড্রোজেনের আইসোটোপ) মতো নিউক্লিয়াস তৈরি হয়েছে তারও আগে। প্রোটন এবং নিউট্রন একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তৈরি করেছিল নিউক্লিয়াস। তাহলে বড় পরমাণু কীভাবে তৈরি হলো?

সাধারণত কার্বন থেকে লোহা তৈরি হয় সূর্যের চেয়ে বড় নক্ষত্রগুলোর ভেতরে। যেখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় লোহা বা নিকেল থেকে ভারী উপাদান তৈরি হয় না।

হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের ব্যাপারে তো জানলাম। কিন্তু বড় পরমাণু বলতে বোঝাতে চাইছি কার্বন, অক্সিজেন বা লোহা তৈরি হলো কীভাবে। মানুষও তো পরমাণু দিয়ে তৈরি। এই পরমাণু এল কোথা থেকে?

এসব বড় পরমাণু তৈরি হয় নক্ষত্রের ভেতরে। বড় পরমাণু তৈরি হতে অনেক বেশি শক্তি লাগে। নক্ষত্রের ভেতরের তাপমাত্রা ও চাপে এই শক্তি উৎপন্ন হওয়া সম্ভব। প্রোটন এবং নিউট্রন যখন খুব কাছে আসে, তখন স্ট্রং ফোর্স বা শক্তিশালী পারমাণবিক বলের কারণে এই কণারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম ফিউশন।

সাধারণত কার্বন থেকে লোহা তৈরি হয় সূর্যের চেয়ে বড় নক্ষত্রগুলোর ভেতরে। যেখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় লোহা বা নিকেল থেকে ভারী উপাদান তৈরি হয় না। কারণ, এই মৌল তৈরি হতে দরকার আরও বেশি শক্তির।

তাহলে স্বর্ণ বা সীসার মতো ভারী উপাদানগুলো এল কীভাবে? এর জন্য প্রয়োজন সুপারনোভা বা নক্ষত্রের বিস্ফোরণ। বড় কোনো নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে হঠাৎ নক্ষত্রের ভেতরের অংশ ভেঙে পড়ে এবং তীব্র বিস্ফোরণ হয়। এই বিস্ফোরণের সময় লোহার চেয়ে ভারী উপাদান তৈরি হয় এবং তা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।

সুপারনোভা

মাঝেমধ্যে নিউট্রন স্টার একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তখন বড় আকারের পরমাণু এবং স্বর্ণের মতো মূল্যবান উপাদান তৈরি হয় এবং তা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বিজ্ঞানীরা জানেন, মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটার নামে আরও একটি রহস্যময় বস্তু আছে। এই ডার্ক ম্যাটার সম্ভবত সাধারণত পদার্থের মতো নয়। বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, ডার্ক ম্যাটার কীভাবে তৈরি হয় এবং এটি কী দিয়ে তৈরি।

ডার্ক ম্যাটারের ব্যাপারে এখনো ধোঁয়াশা থাকলেও আমাদের চারপাশে যা যা দেখি, সেগুলো নিশ্চিতভাবে পরমাণুর তৈরি। এই সবকিছুই এক সময় নক্ষত্রের ভেতরের বস্তু ছিল। আমি-আপনি, গাছপালা, পানি, এমনকি পৃথিবীর সবকিছু নক্ষত্রের ধুলা দিয়ে গড়া।

তাই রাতের আকাশের তারা দেখার সময় মনে রাখবেন, ওসব তারা থেকেই এসেছে আমাদের দেহের প্রতিটি পরমাণু। আপনিও একটা তারার অংশ।

লেখক: প্রদায়ক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স