রসনার রস

রন্ধন একটি শিল্প। স্বরলিপির প্রতিটি সুর ঠিকমতো না বাজালে যেমন গান তৈরি হয় না, তেমন না বুঝে রান্নার উপকরণগুলোর মধ্যে সংযোজন ঘটালে চমৎকার কোনো মেনু তৈরি সম্ভব নয়। আবার এ–ও সঠিক, সারেগামা সুরগুলোকেই একটু এদিক-সেদিক করে নতুন মোহনীয় সুরের জন্ম হয়। রান্নাও ঠিক তেমন। ফ্রান্সের রসায়নবিদ হার্ভে, যাঁকে বলা হয় আণবিক সুখাদ্য ভোজনবিদ্যার জনক, স্বয়ং তিনিই রান্নাকে এমন চমৎকার উপমা দিয়েছেন। ‘নোট বাই নোট কুইজিন’ বা সুরে সুর মিলিয়ে রান্না, এই অন্য রকম অভিব্যক্তির জন্ম দেন তিনি ১৯৯৪ সালে। এটা অনেকটা নতুন মিউজিক তৈরির মতোই রোমাঞ্চকর। রান্নার উপকরণগুলো হলো বাদ্যযন্ত্র, আর রান্নাটি কোনো শিল্পীর তৈরি করা মিউজিক! হার্ভে বলতে চেয়েছেন, ‘নোট বাই নোট কুইজিন’–এর আনন্দটুকু এখানেই। মিউজিকের আদলে রান্না!

রান্নার খুঁটিনাটি বোঝার জন্য প্রায় ২০ বছর ধরে বিজ্ঞানী ও রাঁধুনিরা রান্নার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে গবেষণা করছেন। রান্নার সময় রাসায়নিকভাবে রান্নার উপকরণগুলোর যে অন্তর্বর্তী পরিবর্তন হয়, এ নিয়ে গবেষণার খোরাক, এই আণবিক সুখাদ্য ভোজনবিদ্যারই অনেক শাখার মধ্যে অন্যতম।

ড. সেবাস্তিয়ান আহনার্ট, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি পৃথিবীর প্রায় ৫৬ হাজার রেসিপি নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণার বিষয়বস্তু, খাবারের বিভিন্ন ঘ্রাণ ও স্বাদ–সংবলিত যৌগের মেলবন্ধন ঘটিয়ে নতুন ধরনের খাবার তৈরি! তাঁদের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে এই আস্বাদন যৌগের মেলবন্ধনের চর্চা খুব বেশি পরিমাণে হয়! যেমন বাটারের সঙ্গে ভ্যানিলা কিংবা ডিম সুগন্ধি যৌগ বয়ে বেড়ায়।

পূর্ব এশীয় দেশগুলোয় ব্যাপারটা একেবারেই উল্টো! সেখানে খাবারের উপাদানগুলোর পার্থক্য হয় আকাশ–পাতাল। অন্তর্বর্তী যেকোনো ধরনের যোগাযোগ যেখানে অনুপস্থিত। যেমন: ভাত, সয়া সস, আদা একত্রে মিশিয়ে রান্না সেখানে চলে না! আহনার্টের গবেষণা দল মূলত এখন এই অঞ্চলের খাবার নিয়েই গবেষণা করছে। একটা ব্যাখ্যা দিতে চান, হতে পারে পূর্ব এশীয় দেশগুলোয় সংস্কৃতিকে অনেক প্রাধান্য দেওয়া হয়, যে কারণে তারা খাবারের উমামি স্বাদটিকেই সবচেয়ে বেশি ভরসা করে থাকে!

আহনার্ট ভাবেন, একই সঙ্গে অনেকগুলো রিসেপ্টরকে কার্যক্ষম করা যায়। যেমন কফির কথাই ভাবা যাক। কফির মধ্যে বিভিন্ন সুগন্ধি যৌগ বিদ্যমান। এটি একই সঙ্গে বিভিন্ন রিসেপ্টরকে উত্তেজিত করতে পারে। এই জটিল কাঠামোর কফি মাংসের সঙ্গেও নির্দ্বিধায় মিলিত হতে পারে! এখন কফিকে যদি ‘স্টক’–এর বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়? নিঃসন্দেহে এটি বিভিন্ন ধরনের উপাদানকে একসঙ্গে বেঁধে রাখতে সক্ষম হবেই!

আহনার্টের মতোই ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার বারহাম খাদ্যের স্বাদ নিয়ে আগ্রহী। খাদ্যের বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে, আণবিক সুখাদ্য ভোজনবিদ্যার ওপর আস্থা রেখেই তিনি ভাবছেন, কেন একটা খাবার এত সুস্বাদু, কেনই বা অন্য একটি খাবার এত বিস্বাদ! সে জন্য রেস্তোরাঁয় প্রশ্নোত্তর পর্বের মতো এক উপায় তিনি বের করেছেন। তাতে রেস্তোরাঁয় খেতে আসা মানুষদের খাবারের চাহিদা আগে জেনে নেওয়া হবে, তারপর সে অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা হবে! কোনো রকম তৈরি খাবার আগে থেকে সেখানে ভোজনবিলাসী মানুষদের পছন্দ করার জন্য থাকবে না! এই পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি গবেষণা করতে চান, খাবারের বিজ্ঞান অর্থাৎ অন্তর্বর্তী স্বাদ–যৌগের যোগাযোগ নিয়ে!

বারহাম আবেদন করছেন, যেন শিশুদের প্রারম্ভিক বয়সেই খাদ্যের মূল বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করা যায়। পরিবারের পাশাপাশি এমনকি বিদ্যালয়েও যদি পদার্থ ও রসায়ন ক্লাসে রান্নার ব্যবহারিক দিক নিয়ে মজার ছলে পুরো ব্যাপারটি বোঝানো যায়, ফল হবে অসাধারণ। তখন শিশুরা নিজে থেকেই শিখতে পারবে, কোন খাবার মেদ বৃদ্ধি করে অবসন্ন করে, কোন খাবার তারা বর্জন করবে। এমনকি পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন রেখে কোন খাবারের স্বাদ ও গন্ধে চমৎকার নতুনত্ব নিয়ে আসা যায়, সেটিও তারা নিজেরাই হাতে–কলমে শিখে নিতে পারবে! হার্ভের আণবিক সুখাদ্য ভোজনবিদ্যাকেন্দ্রিক গবেষণাও এগোচ্ছে। কেমন করে খাদ্যের অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন স্বাদ ও ভিন্নতা আনে, সেই বিজ্ঞানের চর্চা তো চলছেই, সঙ্গে সঙ্গে খাবারবিষয়ক এই বার্তাও ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস তাঁদের, “ঐতিহ্য আনে অলসতা, চলো এবারে নতুন কিছুর দিকে অগ্রসর হই!

রন্ধন উপকরণগুলোর কিছু অদ্ভুত যুগল, কিন্তু স্বাদে অনন্য!

সাদা চকলেট, সঙ্গে ক্যাভিয়ার

এই ভিন্নধর্মী খাবার দুটিকে একত্রে এনে সেতুবন্ধ তৈরি করে নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ ট্রাইমিথাইল–অ্যামাইন!

চকলেট ও ফুলকপি

চকলেট আর ভাজা পেঁয়াজ যুগলের মতো চকলেটের সঙ্গে ফুলকপির বোঝাপড়াটাও বেশ ভালো! স্বাদে তো ভিন্নতা থাকেই, আর মজার ব্যাপার লুকিয়ে আছে সালফারে! এই দুই খাবারই সালফারসমৃদ্ধ। সালফারের হাত ধরে আরও শক্তিশালী বন্ধুত্ব তৈরিতে এরা পারদর্শী!

আম ও গাজর

ব্লুমেন্থাল যুগল, যারা আয়োনোন নামক ফুলেল যৌগ একসঙ্গে ভাগাভাগি করে। আয়োনোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সুগন্ধিতে। গাজরের মুগ্ধকর রঙের পেছনের কারিগর। ক্যারোটিন যৌগ যখন ভাঙতে থাকে, তখন তৈরি হয় বিটা আয়োনোন। একই যৌগ আমের মধ্যেও পাওয়া যায়!

স্ট্রবেরি ও ধনেপাতা

স্ট্রবেরি আর ধনেপাতার যুগপৎ ঘটানোয় দায়ী অ্যারোমা যৌগ। বিভিন্ন ফুল ও মসলা প্রজাতির গাছে হেক্সেনাল ও লাইনালুল নামের অ্যালকোহল পাওয়া যায়। এগুলোই স্ট্রবেরি ও ধনেপাতার মধ্যে মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করে।