আদার রসায়ন

আদা এমন একটি মসলা, যা খুব সহজেই রান্নাঘর ও সুপারমার্কেটগুলোতে পাওয়া যায়। আদাকে আমরা হয়তো তাজা বা শুকনা মূল হিসেবে অথবা গুঁড়া হিসেবে কিনতে পারি। রান্নায় আদা ব্যবহার করলে খাবারে একটি তীব্র ঝাঁজালো স্বাদ যুক্ত হয়। এর কারণ, কিছু রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতিতে আদা যখন রান্না করা হয় কিংবা শুকানো হয়, তখন এর স্বাদেও পরিবর্তন আসে। এই যৌগগুলোর মধ্যে কোনো স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে কি না, এমনকি এরা টিউমার সেলের বিরুদ্ধে কার্যকর কি না, এ সম্ভাবনা দেখার জন্য অনেক পরীক্ষা করা হয়েছে।

অন্য সব মসলার মতো আদার তরতাজা মূলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক যৌগ। এর মধ্যে মূলের জন্য প্রয়োজনীয় তেলের প্রায় ৩০ শতাংশ প্রধানত জিঞ্জিবারিন থেকে আসে। এ ছাড়া স্বাদ সৃষ্টির জন্য বিটা-সেসকুইফিল্যানড্রিন ও কারকিউমিন দায়ী। ঝাঁজের কারণ জিঞ্জেরোলসের উপস্থিতি, যার প্রধান উপাদান ৬-জিঞ্জেরোল। এই বিশেষ যৌগের সঙ্গে মরিচের ঝাল সৃষ্টিকারী ক্যাপসিসিন কিংবা কালো গোলমরিচের পাইপারিনের খুব একটা পার্থক্য নেই।

আদার এই সুগন্ধি অনেকগুলো যৌগের সমন্বয়ে তৈরি। তাজা আদার ঝাঁজ জিঞ্জেরোল যৌগ থেকে আসে। এর সুগন্ধি আসে জিঞ্জিবারিন থেকে। রান্নার সময় জিঞ্জেরোল ভেঙে কম ঝাঁজালো যৌগ জিঞ্জেরোন তৈরি হয়। এটা আদার গন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাপ বাড়ার কারণে শোগল নামের আরও যৌগ তৈরি হয়। এটিও স্বাদ ও ঝাঁজে অবদান রাখে।

আদার মধ্যে থাকা অনেকগুলো যৌগ আবার জৈব সক্রিয় পদার্থ। শোগোলের কাশি প্রতিরোধী প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে জিঞ্জেরোল প্রদাহবিরোধী ও ব্যথানাশক উপাদান দিয়ে তৈরি। গবেষণার ফল বলে, টিউমার চিকিৎসায় উপকারী ৬-জিঞ্জেরোল নতুন রক্তকণিকা উৎপাদনে বাধা দেয়। এ ছাড়া এটি গর্ভাবস্থায় ও কেমোথেরাপি চলাকালীন ঘা গলানো কিংবা বমি বমি ভাবের চিকিৎসায় প্লাসেবোর চেয়ে বেশি কার্যকর।

আদার ব্যাপক চাহিদার কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী উপাদান রয়েছে এতে। পর্যবেক্ষণে এর প্রমাণ মিলেছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় আদার যৌগিক প্রয়োগের কিছু উপকার পাওয়া গেছে। আদায় থাকা বেশ কয়েকটি যৌগের প্রদাহবিরোধী ও ব্যথানাশক বৈশিষ্ট্য আছে। নন–স্টেরয়ডাল অ্যান্টি–ইনফ্ল্যাম্যাটরি ওষুধের মতোই আদাও পোস্টগ্ল্যানডিন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার ফল বলছে, ৬-শোগোলের রয়েছে শক্তিশালী কাশি প্রতিরোধী প্রভাব। এটি রক্তচাপ কমাতেও কার্যকর। এটি মাস্ট কোষ থেকে হিস্টামিন নিঃসরণে বাধা দেয়। তাই এর কিছু অ্যালার্জিবিরোধী উপাদানও থাকতে পারে। পরে যা অ্যালার্জেনের প্রতি অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। পাশাপাশি এতে জ্বর প্রতিরোধী প্রভাবও লক্ষ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৬-জিঞ্জেরোলের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এটি টিউমার সেলের বিরুদ্ধে কার্যকর এজেন্ট হিসেবে প্রয়োগ করা যায়। গবেষণাগারে ক্যানসারে আক্রান্ত ইঁদুরের শরীরে এটি অ্যান্টি-অ্যাঞ্জিওজেনিক প্রভাব দেখা যায়। সোজা কথায়, এটি নতুন রক্তকণিকা উৎপাদনে বাধা দেয়। টিউমার কোষ শরীরে ছড়িয়ে পড়ার জন্য নতুন রক্তকণিকা দায়ী। তাই ৬-জিঞ্জেরোল টিউমার চিকিৎসায় উপকারী বলে প্রমাণিত হতে পারে। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, ৬-জিঞ্জেরোলের এই টিউমারবিরোধী প্রভাব ইঁদুরের শরীরে দেখা গিয়েছে। সুতরাং ফলাফল আশাব্যঞ্জক হলেও মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম কাজ করে কি না, সে কথা এখনই জোর দিয়ে বলা যায় না। আশার কথা হলো, ৬–শোগল মানুষের ডিম্বাশয়ের ক্যানসার কোষ বৃদ্ধিতে বাধা দেয়, ল্যাব টেস্টে এর কিছু প্রমাণ মিলেছে। তবু খাবারে প্রচুর আদা যুক্ত করার আগে এটাও মাথায় রাখা উচিত, অতিরিক্ত আদা একই সঙ্গে বুক জ্বালাপোড়া ও ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। সুতরাং পরিমিত আদা ব্যবহার করুন।