পর্যায় সারণির যেসব মৌল প্রাণঘাতী

১১৮টি মৌল নিয়ে আমাদের আধুনিক পর্যায় সারণি। এ পর্যায় সারণির সূচনা রুশ রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলিভের হাতে। এতে জীবনের জন্য অপরিহার্য মৌল অক্সিজেন যেমন আছে, তেমনি আছে জীবন বিপন্নকারী আর্সেনিকের মতো মৌলও। এই মৌলগুলো এত বিপজ্জনক যে এদেরকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী মৌল’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু কীসের ওপর ভিত্তি করে এদের এই নাম দেওয়া হলো?

তিনটি প্রধান ক্যাটাগরির ওপর ভিত্তি করে এই মৌলগুলোকে আলাদা করা হয়। তেজস্ক্রিয়তা, বিষাক্ততা ও বিক্রিয়ার প্রবণতা।

প্রথমে আসা যাক তেজস্ক্রিয়তার কথায়। কোনো মৌলের তেজস্ক্রিয়তা বলতে আসলে কী বোঝায়?

১৮৯৬ সালে ফরাসি পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। এটি সে সময় ছিল শুধুই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। পর্যায় সারণির কিছু অস্থিতিশীল মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াস নিজ থেকেই ভেঙে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের রশ্মি বা কণা নির্গত হয়। এই ঘটনাকেই তেজস্ক্রিয়তা বলা হয়। যেমন ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম বা পোলোনিয়ামের মতো মৌলের কথা বলা যায়। এরা তেজস্ক্রিয় মৌল। এদের নিউক্লিয়াস থেকে আলফা, বিটা বা গামা রশ্মি নির্গত হয়। এই রশ্মিগুলো উচ্চ ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং জীবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

এখানে দুটি জিনিস বলে রাখা উচিৎ। এক, মেরি ও পিয়ের কুরিও কাছাকাছি সময়ে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সে জন্য ১৯০৩ সালে বেকেরেল, মেরি ও পিয়ের কুরি—এই তিন বিজ্ঞানীকে তেজস্ক্রিয়তাবিষয়ক গবেষণার জন্য যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। দুই, পরে লিজ মাইটনার এবং অটো হান ফিশন বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন। এভাবে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা বা ইউরেনিয়ামের মতো মৌল কৃত্রিমভাবে ভেঙে তেজস্ক্রিয়তা নির্গমনের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। 

এরপর আসা যাক মৌলের বিষাক্ততার বিষয়ে। মৌলের বিষাক্ততা আসলে কী? কোনো মৌল পরিবেশ অথবা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তার একটা সাধারণ মাপকাঠি হলো বিষাক্ততা। ধরা যাক, আপনাকে কোনো বিষাক্ত সাপে কেটেছে। সাধারণভাবে আপনার আক্রান্ত স্থান ফুলে উঠবে ও রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করবে। ঠিক তেমনি বিষাক্ত মৌলগুলোর কোনোটি যদি আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করি অথবা খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলি, তখন আমাদের শরীরে বিষক্রিয়া দেখা দেবে। আবার বিষাক্ত মৌলগুলোর কোনোটি যদি পরিবেশে মিশে যায়, তাহলে সেগুলো অন্যান্য প্রাণীর দেহেও বিষক্রিয়া ঘটাবে।

এরপর রয়েছে মৌলের বিক্রিয়ার প্রবণতা। একটি মৌল কতটা দ্রুত অন্য মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নতুন যৌগ তৈরি করতে পারে, তার একটি সাধারণ পরিমাপ হলো এই বিক্রিয়ার প্রবণতা। সাধারণভাবে আমরা জানি, কোনো মৌলের সর্বশেষ শক্তিস্তর থেকে যত সহজে ইলেকট্রন বের হয়ে যেতে পারে (ধাতু) বা অন্য পরমাণু থেকে কোনো মৌল যত সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে (অধাতু), তার বিক্রিয়ার প্রবণতা তত বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিক্রিয়ার প্রবণতা বেশি হওয়াটা কেন বিপজ্জনক?

পর্যায় সারণিতে কিছু মৌল আছে, যেগুলো এত বিক্রিয়াপ্রবণ যে সামান্য বাতাস বা পানির সংস্পর্শে এলেই সেগুলো প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হয় এবং আগুন ধরে যায়। মজার ব্যাপার হলো, কিছু মৌল বিভিন্ন মানদণ্ডে বিষাক্ত বা বিক্রিয়াপ্রবণ হলেও সেগুলো দিয়ে তৈরি যৌগ একদম নিরাপদ। এসব যৌগ আমরা প্রতিদিনই ব্যবহার করি। যেমন সোডিয়াম অত্যন্ত বিক্রিয়াপ্রবণ একটি মৌল। আবার ক্লোরিন একটি বিষাক্ত মৌল। কিন্তু এই দুটি মৌল দিয়ে তৈরি সোডিয়াম ক্লোরাইড আমরা প্রতিদিনই লবণ হিসেবে খাই ও রান্নায় ব্যবহার করি।

এবারে চলুন, পর্যায় সারণির কিছু বিপজ্জনক মৌল সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।

১. হাইড্রোজেন

পর্যায় সারণির প্রথম মৌল এটি। অত্যন্ত দাহ্য। মানে খুব সহজেই আগুন ধরে যায়। এটি বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলে আগুন বা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। কিন্তু এই হাইড্রোজেন আবার অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে জীবনের জন্য অপরিহার্য উপাদান পানি তৈরি করে।

২. সিজিয়াম

এটি পর্যায় সারণির ৫৫ নম্বর মৌল। এটি দাহ্য ও বিস্ফোরক। বাতাসে রাখলে এতে আগুন ধরে যায় এবং পানির সংস্পর্শে এলে প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হয়।

৩. ক্রোমিয়াম

এটি পর্যায় সারণির ২৪ নম্বর মৌল। দেখতে ইস্পাতের মতো ধূসর, চকচকে। এ কারণে অনেক সময় গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরিতে ক্রোমিয়াম ধাতু ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ক্রোমিয়ামের হেক্সাভ্যালেন্ট অবস্থা (Cr-VI), যেখানে পরমাণুটি ছয়টি ইলেকট্রন ভাগাভাগি করে, তা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। তখন একে কার্সিনোজেনিক ক্রোমিয়াম বলা হয়। কার্সিনোজেনিক মানে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বস্তু।

৪. ক্যাডমিয়াম

পর্যায় সারণির ৪৮ নম্বর মৌল। বিষাক্ত, দেখতে রুপালি সাদা। রাসায়নিক ধর্মে দস্তা বা জিঙ্কের সঙ্গে মিল আছে। মানবদেহে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি ক্যালসিয়ামের কার্যকারিতায় বাধা দেয়।

৫. থ্যালিয়াম

এটি পর্যায় সারণির ৮১ নম্বর মৌল। বিষাক্ততার জন্য থ্যালিয়াম বেশ পরিচিত। এর সামান্য মাত্রাও খুব বিষাক্ত। মানবদেহে এর উপস্থিতি কোষের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

৬. সিসা

ইংরেজি নাম লেড। অত্যন্ত বিষাক্ত। এটি পর্যায় সারণির ৮২ নম্বর মৌল। একসময় প্রিন্টিং প্রেসে, রং এবং পেট্রোলে সিসার ব্যাপক ব্যবহার ছিল। কিন্তু মারাত্মক বিষাক্ততার কারণে সিসার ব্যবহার সীমিত করা হয়। মানবদেহে সিসা প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক ও কিডনির ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

৭. আর্সেনিক

পর্যায় সারণিতে এর অবস্থান ৩৩তম। বিষাক্ততার বিচারে আর্সেনিকের জুড়ি মেলা ভার। পর্যায় সারণিতে ফসফরাসের ঠিক নিচেই এর অবস্থান। অর্থাৎ এরা একই গ্রুপের মৌল। এ কারণে এর বৈশিষ্ট্য অনেকটা ফসফরাসের মতো। ফসফরাস শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মৌল। কিন্তু আমাদের দেহকোষ অনেক সময় আর্সেনিককে ফসফরাস ভেবে ভুল করে বসে। ফলে কোষের কার্যক্রমে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে।

৮. ফ্লোরিন

পর্যায় সারণির নবম মৌল ফ্লোরিন। এর পারমাণবিক গঠন এই মৌলকে অন্য পরমাণু থেকে ইলেকট্রন গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী করে তোলে (সর্বোচ্চ তড়িৎ ঋণাত্মকতা)। তাই ফ্লোরিন প্রচণ্ড বিক্রিয়াপ্রবণ একটি মৌল। ফলে ফ্লোরিনের ক্ষয় করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। এটি প্রায় সবকিছু ক্ষয় করে ফেলতে পারে। ক্ষয়কারী মৌল হিসেবে ফ্লোরিনের বেশ দুর্নাম রয়েছে।

৯. অ্যান্টিমনি

পর্যায় সারণিতে অ্যান্টিমনির অবস্থান আর্সেনিকের ঠিক নিচে। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৫১। দুটি মৌলের বিষাক্ততার প্রভাবও প্রায় একই রকম। অ্যান্টিমনি মানুষের লিভার বা যকৃতের ক্ষতি করে এবং এর বিষক্রিয়ার ফলে প্রচুর বমি হয়।

১০. প্লুটোনিয়াম

তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়ামের পারমাণবিক গঠন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৯৪। প্লুটোনিয়াম অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় মৌল। তেজস্ক্রিয় হওয়ার অর্থ হলো, এর পরমাণুগুলো ভেঙে আলফা, বিটা আর গামা রশ্মি নির্গত হয়, যা জীবকোষের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। জাপানের নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা ‘ফ্যাট ম্যান’ বোমাটি ছিল যুদ্ধে ব্যবহৃত দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা, যা তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম-২৩৯ (Pu-239) দিয়ে বানানো হয়েছিল।

লেখক : শিক্ষার্থী, হেলথ এন্ড লাইফ সায়েন্স অনুষদ, কৃষিবিজ্ঞান বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সূত্র : হাউ ইট ওয়ার্কস ও থটকো ডট কম