আমাদের চারদিকে সংঘটিত অগণিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার সবকটিই ইলেকট্রন কক্ষপথের রসায়নের নিয়মাধীন। পরমাণু ইলেকট্রন ত্যাগ বা গ্রহণ করে, ধনাত্মক বা ঋণাত্মক আধানযুক্ত আয়নে পরিণত হয়। হাজার হাজার পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরমাণু মহাণু (বড় অণু) তৈরি করতে পারে। কিন্তু এতেও মৌলবিশেষের ধর্মচ্যুতি ঘটে না। কার্বনের যৌগ সংখ্যা বিশ লাখেরও বেশি। কিন্তু হোক তা CO₂ বা যেকোনো জটিলতম অ্যান্টিবায়োটিক, কার্বন কার্বনই থাকে।
একটি মৌলকে অন্যটিতে রূপান্তরণে এদের নিউক্লিয়াসের পুনর্বিন্যাস ও আধানের পরিবর্তন প্রয়োজন।
রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটনে বিজ্ঞানীরা উচ্চতাপ ও চাপ এবং অনুঘটক ব্যবহার করেন। প্রসঙ্গত, অনুঘটক এমন উপাদান যার অতি অল্প পরিমাণ রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরিত করে।
হাজার হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং সাধারণ চাপমাত্রার বহু লাখ গুণ অধিক চাপও পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের পুনর্বিন্যাসে অক্ষম। এভাবে কোনো মৌলকে অন্য মৌলে রূপান্তরিত করা যায় না।
মানুষের তৈরি প্রথম কৃত্রিম মৌলের নাম দেওয়া হয় গ্রিক ‘টেকনেটোস’ (কৃত্রিম) শব্দটি থেকে। ১৯৩৬ সালের শেষদিকে সাইক্লোট্রনে ত্বরিত নিউট্রনপুঞ্জ সবেগে মোলিবডেনাম পাতে পিষ্ট হলো।
কিন্তু নতুন বিজ্ঞান—নিউক্লীয় রসায়নের সাহায্যে তা সম্ভব। নিউক্লীয় রসায়নের ‘তাপ ও চাপের’ বিকল্প প্রোটন, নিউট্রন, ভারি হাইড্রোজেন আইসোটোপের নিউক্লিয়াস (ডিটেরন), হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস (আল্ফা কণা) এবং শেষে মেন্ডেলিভের সারণির লঘুতর মৌল, বোরন, অক্সিজেন, নিয়ান ও আর্গনের আয়নরাশি। বোমা-কণার উৎপাদক নিউক্লীয় রিয়েক্টর এবং ত্বরকযন্ত্র (কণাসমূহে অভাবনীয় বেগ সঞ্চারক জটিল যন্ত্রপাতি) এর রাসায়নিক সাজসরঞ্জামের অন্তর্ভুক্ত। পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেদের জন্য উচ্চ শক্তিধর কণা-গোলা নিক্ষেপ অপরিহার্য (বিশেষত, তা ধনাত্মক আধানযুক্ত হলে)। বিকর্ষী নিউক্লিয়াসের আধানকে পরাজিত করার এই সহজ পথ। নিউক্লীয় রসায়নের নিজস্ব প্রতীক সত্ত্বেও এর বিক্রিয়ার সমীকরণগুলো ‘প্রচলিত’ রাসায়নিক সমীকরণেরই অনুরূপ।
নিউক্লীয় রসায়নেরই বদৌলতে শেষ পর্যন্ত মেন্ডেলিভের সারণির শূন্য স্থানগুলো পূর্ণ হয়েছিল।
মানুষের তৈরি প্রথম কৃত্রিম মৌলের নাম দেওয়া হয় গ্রিক ‘টেকনেটোস’ (কৃত্রিম) শব্দটি থেকে। ১৯৩৬ সালের শেষদিকে সাইক্লোট্রনে ত্বরিত নিউট্রনপুঞ্জ সবেগে মোলিবডেনাম পাতে পিষ্ট হলো। ছুরি যেমন মাখন কাটে তেমনি ত্বরিত নিউট্রন ইলেকট্রন খোলক ছিন্ন করে সহজেই নিউক্লিয়াসে পৌঁছল। একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রনধারী প্রতিটি ডিউটেরন নিউক্লিয়াসকে আঘাত করেই ভেঙে পড়ল। নিউট্রনটি ছিটকে বেরিয়ে গেল, কিন্তু প্রোটনটি আটকে গেল নিউক্লিয়াসে। ফলে, নিউক্লিয়াসের আধানে একটি একক বৃদ্ধি পেল আর ৪২ নং ঘরের বাসিন্দা মোলিবডেনাম বদলে গেল তার ডান দিকের ৪৩ নং ঘরের মৌলে।
সাধারণ রসায়নে একটি যৌগই বিবিধভাবে তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লীয় রসায়নেও প্রক্রিয়াটি প্রযোজ্য। এখানেও বিবিধ নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় একই কৃত্রিম মৌল উৎপাদন করা যায়।
বাড়ির নতুন একটি এলার ভিত তৈরি শেষ হওয়ার পরদিনই সব ইট বেমালুম উধাও হয়ে গেলে মিস্ত্রিটির অবস্থা কেমন হবে, তা একবার কল্পনা করুন। ভারি ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌলের রাসায়নিক গুণাগুণ সন্ধানীরা ঠিক এমনি দুর্ভাগ্যের শিকার।
আমরা বিশ্বের বহু কিলোগ্রাম পরিমাণে টেকনেসিয়াম তৈরির কৌশল আয়ত্ত করলাম বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্য কারখানাটিতে—নিউক্লীয় রিয়েক্টরে। শ্লথগতি নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস ভেঙে এখানে শক্তি উৎপন্ন করা হয়।
ইউরেনিয়ামের প্রত্যেক নিউক্লিয়াস দুই ভাগ হয়ে নানা ধরনের টুকরো উৎপাদন করে। টুকরোগুলো হলো মেন্ডেলিভ সারণির কেন্দ্রস্থ মৌলগুলোর পারমাণবিক নিউক্লিয়াস। ভেঙে পড়া ইউরেনিয়াম থেকে জন্মে পর্যায়বৃত্ত সারণির ৩০ থেকে ৬৪নং পর্যন্ত ত্রিশের বেশি কক্ষের বাসিন্দা মৌল। টেকনেসিয়াম এবং পৃথিবীতে এর আগে অনেক চেষ্টায়ও পাওয়া যায়নি এমন আরও একটি মৌলও এগুলোর অন্তর্ভুক্ত। ৬১নং ঘরের বাসিন্দা এই মৌলটির নাম প্রোমেথিয়াম।
নিউক্লীর রসায়নের বদৌলতে বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়ামের চেয়েও ভারি মৌল হাতে পেলেন। ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনের ফলে উৎপন্ন টুকরোগুলোর সঙ্গে বহুসংখ্যক নিউট্রনও থাকে এবং সেগুলো অখণ্ড নিউক্লিয়াসের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে, ৯৩, ৯৪ ইত্যাদি পারমাণবিক সংখ্যার মৌলের সংশ্লেষ সম্ভব হয়। এগুলো ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল নামে খ্যাত।
আমরা বিশ্বের বহু কিলোগ্রাম পরিমাণে টেকনেসিয়াম তৈরির কৌশল আয়ত্ত করলাম বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্য কারখানাটিতে—নিউক্লীয় রিয়েক্টরে। শ্লথগতি নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস ভেঙে এখানে শক্তি উৎপন্ন করা হয়।
পূর্বোক্ত মৌল উৎপাদনের বিবিধ পদ্ধতি এখন নিউক্লীয় রসায়নের দখলে। অদ্যাবধি ১৪টি ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল সংশ্লেষিত হয়েছে। এগুলো নেপচুনিয়াম, প্লুটোনিয়াম, অ্যামিরিসিয়াম, কুরিয়াম, বার্কেলিয়াম, ক্যালিফোর্নিয়াম, আইনস্টাইনিয়াম, ফার্মিয়াম, মেন্দেলেভিয়াম, লরেন্সিয়াম, কুর্চাতভিয়াম, নিলসবোরিয়াম এবং ১০৬নং মৌল।
বাড়ির নতুন একটি এলার ভিত তৈরি শেষ হওয়ার পরদিনই সব ইট বেমালুম উধাও হয়ে গেলে মিস্ত্রিটির অবস্থা কেমন হবে, তা একবার কল্পনা করুন। ভারি ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌলের রাসায়নিক গুণাগুণ সন্ধানীরা ঠিক এমনি দুর্ভাগ্যের শিকার। মৌলগুলো একেবারেই অস্থায়ী। এদের আয়ু মিনিট বা সেকেন্ডে পরিমাপ করা হয়। সাধারণ কোনো মৌল নিয়ে কাজ করার সময় রাসায়নিকের সময়ের কোনো তাড়া থাকে না। কিন্তু যখনই তিনি পর্যায়বৃত্ত সারণির ক্ষণজন্মাদের, বিশেষভাবে ভারি ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌলে হাতে দেন, তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত তখন সোনার চেয়েও দামি। এখানে পরীক্ষাধীন পদার্থটির ক্ষণস্থায়ীত্বই শুধু নয়, এর অতি অল্প পরিমাণও এক জটিল সমস্যা যা কখনো সত্যিই কয়েকটি পরমাণু মাত্র।
তাই বিশেষ ধরনের গবেষণাপদ্ধতির সাহায্য ছাড়া বিজ্ঞানীরা এখানে নিরুপায়। তাঁরা এখানে রসায়নের নবজাত শাখা রসায়নের তেজস্ক্রিয় নিয়মাধীন।