অতি বিশাল মহাবিশ্বে ছোট্ট এক গ্রহ—পৃথিবী। প্রাণ বা জীবন বলতে আমরা যা বুঝি, তার সবটা এখানেই। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে জীবনের কোনো সন্ধান মেলেনি। কিন্তু মহাবিশ্ব জায়গাটা এত বড় যে ভিনগ্রহে প্রাণী থাকার সম্ভাবনা কোনোভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ান। এ জন্য সবার আগে খোঁজেন পানির উপস্থিতি। কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে পানি না থাকলে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী সেখানে প্রাণ খোঁজার আগ্রহ পান না। কিন্তু কেন? প্রাণের জন্য পানিকে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়?
পানির রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য ও জীবনের মৌলিক কার্যক্রমের দিকে তাকালে মিলবে এর উত্তর। পানির একটি অণুতে রয়েছে দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু। আকারে ছোট হাইড্রোজেন দুটি ধনাত্মকভাবে চার্জিত। আর বড় অক্সিজেন পরমাণুটির চার্জ ঋণাত্মক। এরকম রাসায়নিক গঠন ও বন্ধনের ধরনের কারণে পানির অণুতে তৈরি হয় পোলারিটি বা মেরুধর্ম। অর্থাৎ পানির অণু হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মৌলে ভেঙে না গেলেও এর একপাশ কিছুটা ধনাত্মক এবং অন্যপাশ কিছুটা ঋণাত্মক ধর্মের।
বিপরীতধর্মী এই চার্জের জন্য পানির অণু একটি অন্যটির সঙ্গে লেগে থাকে। একই কারণে এটি অন্য পদার্থের অণুর চার্জিত অংশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়াতে পারে। এভাবে মৌলকে ভাঙতে ও দ্রবীভূত হতে সাহায্য করে পানি।
এবার দেহকোষের দিকে একটু তাকানো যাক। প্রাণীর দেহকোষে চলে হাজারও রাসায়নিক বিক্রিয়া। এসব বিক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট অণুর অবাধ মেশার ক্ষমতা থাকা দরকার। কোনো কিছুতে দ্রবীভূত হওয়া দরকার। পানি খুব ভালো দ্রাবক—যেকোনো কিছুকে খুব ভালোভাবে দ্রবীভূত করতে পারে। এ জন্য একে সর্বজনীন দ্রাবক বলা হয়।
অন্য কিছু পদার্থেরও পানির মতো দ্রবীভূত করার ক্ষমতা আছে। তবে এগুলোর রাসায়নিক স্থিতিশীলতা নেই। তা ছাড়া পানি শক্তিশালী এসিড ও ক্ষারকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে পারে।
এ ছাড়া জীবিত কোষের আবরণ বা কোষ ঝিল্লি তৈরিতে সাহায্য করে পানির মেরুধর্ম। লিপিড নামের বিশেষ ধরনের চর্বিজাতীয় কোষ বাইরের দিকে পানি আকর্ষী এবং ভেতরের দিকে পানিবিকর্ষী নমনীয় পর্দা তৈরি করে। এ পর্দা দুই স্তরবিশিষ্ট। অনেকটা সাবানের বুদবুদের আবরণের মতো। লিপিডের এই পর্দা জীবনের জন্য দরকারি জটিল সব উপাদান আলাদা রাখে।
পানির অণুগুলোয় পরস্পরের প্রতি বিশেষ এক আকর্ষণ বল কাজ করে। একে বলা হয় সংসক্তি বল। এর পেছনেও দায়ী এর পোলারিটি বা মেরুধর্ম। সংসক্তি বলের কারণে খুব পাতলা নলের মধ্য দিয়েও পানি ওপরে উঠে আসে। উপেক্ষা করতে পারে মহাকর্ষ বল। মাটি থেকে শত ফুট ওপরে, গাছের কাণ্ডে পানি এভাবে পৌঁছায়। বয়ে নেয় প্রয়োজনীয় পুষ্টি। আবর্জনা পরিষ্কার, গঠন-কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ—সবই করতে পারে পানি তার এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য। সালোকসংশ্লেষণেও পানির ভূমিকা প্রবল। সূর্যের আলো ও কার্বন ডাই-অক্সাইড দিয়ে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা তৈরির জন্য পানি দরকার।
আসলে জীবনের জন্য পানি কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে মোটা মোটা বই লিখে রেখেছেন গবেষকেরা। সব তো আর এ লেখায় বলা সম্ভব নয়। বরং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। পানি ছাড়া কি কোনো জীবনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্ভব। আমাদের চেনা-জানা গণ্ডির বাইরে এমন জীবন থাকা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সেটা কীভাবে, সে বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই। কারণ, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। তাই আমরা বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারি না। তবে জীবনের মৌলিক কার্যক্রম, অর্থাৎ শক্তি সরবরাহ, চলাচল ও প্রতিলিপি তৈরির জন্য পানির মতো দ্রাবকের খুবই প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় হলো, পানির সমান তো দূরের কথা, অর্ধেক কাজ করে—এমন কোনো দ্রাবকের কথাও আমরা জানি না।
পানির গুরুত্ব বর্ণনা করতে নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী আলবার্ট ভন সেন্ট-গিওরগি একে জীবনের ‘ম্যাট্রিকস, মা এবং মাধ্যম’ বলেছেন। জীবনের জন্য পানি গুরুত্বপূর্ণ কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু আমরা যে জীবন বা প্রাণসত্ত্বাকে জানি ও চিনি, তার জন্য যে পানির অপর নাম জীবন, সে কথা অনস্বীকার্য।