লবণের প্রেত ক্লোরিন

১৯১৫ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে গোটা ইউরোপে।

রাষ্ট্রনায়কদের নির্দেশে নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত কতিপয় বিজ্ঞানী। ওই বছরের ২২ এপ্রিল পশ্চিম রণাঙ্গণে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে নতুন এক অস্ত্র প্রয়োগ করল জার্মান সেনাবাহিনি। সেটা বিধ্বংসী কোনো বোমা নয়, সামান্য একটা গ্যাস। কিন্তু মারাত্মক তার প্রভাব। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃদুমন্দ বাতাসে সেই গ্যাস ছড়িয়ে পড়ল শত্রুপক্ষের ট্রেঞ্চগুলোতে। প্রথমে কেউ ব্যাপারটাকে সেভাবে পাত্তা দিল না। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৫ হাজারের বেশি সেনাসদস্য ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’।

সেই সঙ্গে পঙ্গু হয়ে গেল আরও ১৫ হাজার। পরে জানা গেল, সেটা ছিল ক্লোরিন গ্যাস। বিষাক্ত। শ্বাসের সঙ্গে গ্যাসটা সরাসরি মানুষের ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। ফুসফুসের পানির কণা ও জলীয়বাষ্পের সঙ্গে মিশে তৈরি করে হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং হাইপোক্লোরাস এসিড। সেটাই ডেকে আনে ভয়াবহ মৃত্যু।

সল অ্যামোনিয়াক মূলত অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড

মৌল হিসেবে ক্লোরিনের সঙ্গে মানুষের পরিচয় খুব বেশি দিন আগের নয়। একক মৌল হিসেবে সেটা মারাত্মক হলেও যৌগ হিসেবে এর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে। আমরা খাবারের সঙ্গে যে লবণ ব্যবহার করি, তাতেও রয়েছে এই মৌলটি। লবণে ক্লোরিন থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড হিসেবে। সোডিয়ামের সঙ্গে যৌগ গঠন করার কারণে তার ক্ষতিকর প্রভাবটা আর থাকে না। তবে শুধু ক্লোরিন বিষাক্ত। তাই একে এখন পানি বিশুদ্ধকরণসহ আরও নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে সেটা করা হয় মাত্রা মেনে। প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলিগ্রামের কম ক্লোরিন থাকলে তা মানুষের ক্ষতি করে না। বরং বিভিন্ন জীবাণুকে মেরে ফেলে মানুষের জন্য পানিকে সুপেয় করে তোলে। পানি বিশুদ্ধকরণে বেশি প্রচলিত ক্লোরিন ট্যাবলেট। তা ছাড়া আমাদের বর্তমান শিল্পক্ষেত্র এবং দৈনন্দিন জীবনে ক্লোরিন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। খাবার লবণের কথা তো আগেই বলেছি। এ ছাড়া পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড), ডিডিটি, সিএফসিসহ (ক্লোরোফ্লুরোকার্বন) আরও গুরুত্বপূর্ণ যৌগে ক্লোরিন রয়েছে।

অতি প্রাচীনকাল থেকে পরোক্ষভাবে ক্লোরিনের ব্যবহার ছিল। ৯০০ সালের দিকে আরব বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান এবং আবু বকর আল-রাজির লেখায় ক্লোরিন যৌগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা জানা যায়। তাঁরা সল অ্যামোনিয়াকের (অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড) সঙ্গে ভিট্রিওল বা তুঁত যোগ করে তৈরি করেছিলেন হাইড্রোজেন ক্লোরাইড। এরপরও ক্লোরিনের যৌগ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন আরব এবং ইউরোপের বিজ্ঞানীরা। তবে একে মৌল হিসেবে চিনতে ব্যর্থ হন।

পানি বিশুদ্ধ করার জন্যেও ব্যবহৃত হয় ক্লোরিন

১৬৫৮ সালের দিকে সাধারণ লবণকে সালফিউরিক এসিডের সঙ্গে মিশিয়ে একটা দ্রবণ পান জার্মান রসায়নবিদ জোহান রুডলফ গ্লোবার। সেটা থেকে বেরিয়ে আসা বাষ্পটা ছিল প্রায় দমবন্ধ করা। বিজ্ঞানী রুডলফ তাই নতুন এই যৌগটার নাম দেন ‘লবণের প্রেত’।

পরীক্ষায় দেখা গেল, দ্রবণ অবস্থায় পদার্থটা এসিডিক বা অম্লধর্মী। আর সেটা বানানো হয়েছিল লবণ থেকে। লবণের প্রধান উৎস সাগরের পানি। এসব কারণে নতুন পদার্থটার নাম দেওয়া হলো মেরিন এসিড বা মিউরিয়াটিক এসিড। এরকম নামের পেছনেও কারণ আছে। আসলে লাতিন শব্দ Mare অর্থ সাগর বা সমুদ্র। এখান থেকেই এসেছে মেরিন (Marine) বা মেরিন এসিড। আর মিউরিয়া অর্থ লবণ।

এখন আমরা জানি, এই এসিডে কোনো অক্সিজেন নেই। আসলে, কোনো এসিডেই অক্সিজেন নেই। কিন্তু ১৭ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, যেকোনো এসিডে অবশ্যই অক্সিজেন থাকবে। বাংলাভাষায় এ সংক্রান্ত পরিভাষাতেও তার প্রমাণ রয়ে গেছে। যেমন সেকালে অক্সিজেন শব্দের বাংলা করা হয়েছিল অম্লজান। অর্থাৎ, এসিডের প্রাণ। যাহোক, বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন, মিউরিয়াটিক এসিড অণু গঠিত হয়েছে অক্সিজেনসহ কোনো অজানা মৌল দিয়ে। অজানা সেই মৌলের নাম দেওয়া হলো মিউরিয়াম।

সবুজ বিষ রূপে ক্লোরিন
সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি

১৭৭৪ সালে এক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটা গ্যাস আবিষ্কার করেন সুইডিশ রসায়নবিদ কার্ল শিলি। গ্যাসটা একটু সবুজ রঙের। রাসায়নিকভাবে সক্রিয় গ্যাসটার গন্ধও বেশ ঝাঁঝাল। কিন্তু সেটা আসলে কোন মৌল হতে পারে, তা বুঝতে ব্যর্থ হন শিলি। তার পেছনের কারণও এসিড নিয়ে সেকালের সেই ভুল ধারণা। একে অতিরিক্ত অক্সিজেনসহ মিউরিয়ারিক এসিড বলে ধারণা করেন তিনি।

এরপরও আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীও এই গ্যাসটা সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেছেন। একে মৌল হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি, ১৮০৮ সালে। তিনি সবুজ গ্যাসটার নাম দেন ‘ক্লোরিন’। কারণ গ্রিক শব্দ ‘ক্লোরোস’ অর্থ সবুজ। পরে রসায়নের পর্যায় সারণির ১৭ নম্বর মৌল হিসেবে জায়গা দখল করে এটি। আর সংকেত দেওয়া হয় Cl।

এই আবিষ্কারের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল, মিউরিয়াটিক এসিড আসলে এক অণু হাইড্রোজেন এবং এক অণু ক্লোরিন দিয়ে গঠিত। তাই মিউরিয়াটিক এসিডের আধুনিক নাম হাইড্রোক্লোরিক এসিড। এটি অন্যতম শক্তিশালী এসিড হিসেবে পরিচিত। আমাদের পাকস্থলীতেও রয়েছে এই এসিড, যা আমাদের পরিপাকক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা