ডিমের রসায়ন

ডিম। খুব সাধারণ একটা খাবার। সহজেই রান্না করে গপগপ করে খেয়ে ফেলা যায়। জিনিসটা দেখতে খুব সহজ–সরল হলেও এর রাসায়নিক গঠন কিন্তু বেশ জটিল। সেই জটিল রাসায়নিক গঠনটাই দেখা যাক—

ডিমের খোসা

ডিমের বাইরের দিকটা থেকেই শুরু করা যাক। প্রাথমিকভাবে বলা যায় খোলস গঠিত হয় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে। একই বস্তু সমুদ্রের শাঁখ, আমাদের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার চক এবং লাইমস্টোনেও আছে। ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের ন্যানো পার্টিকেল প্রোটিনের অর্ডার অনুযায়ী একধরনের ক্রিস্টাল ক্যালসাইট মিনারেল তৈরি করে, এতেই তৈরি হয় ডিমের খোসা। খোসা কিন্তু একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়। একটা ডিমে গড়ে প্রায় ৯ হাজার সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্রগুলো দিয়ে ডিমের ভেতরে গ্যাস ঢোকে আর বেরোয়। রান্নার ক্ষেত্রে এর কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব আছে, সে বিষয়ে পরে আসছি।

ডিমের খোসার রং কিন্তু নানা রকম হতে পারে, যেমন মুরগির ক্ষেত্রে দেখ যায় খোসার রং সাদা বা বাদামি রঙের হয়, কিন্তু অন্যান্য পাখির বেলায় দেখা যায় সবুজ বা নীল রঙের নানা রকম তারতম্য। কোনো কোনো পাখির ডিমে আবার নানা রকম রঙের ফুটকিও দেখা যায়। রঙের এই তারতম্য মূলত মুরগির ডিম্বনালিতে ডিমের খোসা তৈরির সময় পিগমেন্ট (রঞ্জক) ডিপোজিশনের জন্য। একধরনের রঞ্জক আছে প্রোটোপোরফাইরিন ৯। এ কারণে খোসা হয় বাদামি রঙের। এসব রঞ্জক রক্তে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যাওয়া হিমোগ্লোবিনের প্রিকারসর হিসেবে কাজ করে। অন্য যেসব রঞ্জক পদার্থ আছে, যেমন ওসায়ানিনের কারণে খোসার রং হয় নীল বা সবুজ, এই পিগমেন্ট মূলত মুরগির বা পাখির শরীরের যকৃতের বাইল তৈরির সময় সাইড প্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি হয়। আর সাদা খোল হচ্ছে রঞ্জক অণুর অনুপস্থিতি।

ডিমের ভেতরের সাদা অংশ

ডিম ভাঙলেই চোখে পড়ে ডিমের সাদা অংশ। এই অংশে বেশ কয়েকটি স্তর রয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে এর শতকরা ৯০ ভাগই পানি। বাকি ১০ ভাগ নানা রকম প্রোটিন। প্রোটিনগুলোর একটি হলো ওভালবুমিন। এর কাজ ডিমের মধ্যে বেড়ে ওঠা বাচ্চার পুষ্টি সরবরাহ করা এবং নানা রকম হজমি এনজাইম আটকে রাখা। আরেকটা হচ্ছে, কোনালবুমিন বা ওভাট্রান্সফেরিন। এই প্রোটিন লৌহ বা আয়রন অণুর সঙ্গে খুব শক্ত বন্ধন তৈরি করে। ভেতরে ব্যাকটেরিয়ার কোনো সংক্রমণ যাতে না হয়, সেদিকে আবার ডিমের ভেতর বেড়ে ওঠা বাচ্চার শরীরে আয়রন বা লৌহর ঘাটতিও যাতে না দেখা দেয়, সেদিকেও এরা লক্ষ্য রাখে। আরেকটা প্রোটিনও আছে ডিমের সাদা অংশে, নাম ওভোমিউসিন। এই প্রোটিন ডিমের সাদা অংশের ঘনত্ব বাড়ায় এবং ভেতরের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে।

ডিমের কুসুম

ডিমের কুসুম বেশ কিছু গোলীয় প্রকোষ্ঠ দিয়ে তৈরি। এতে প্রচুর ফ্যাটি অ্যাসিড, যেমন ওলেইক অ্যাসিড, পামিটিক অ্যাসিড, লিনোলেয়িক এবং বেশ উঁচু মাত্রার কোলেস্টেরল থাকে। আরও থাকে এই ফ্যাটে দ্রবীভূত হয়, এমন চারটা ভিটামিন—ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই এবং ভিটামিন কে।

ডিমের কুসুমের রং কী হবে, তা ঠিক করে দেয় দুটি রাসায়নিক যৌগ—লুটেইন ও জিয়াজ্যানথিন। এই দুটি যৌগই জ্যান্থোফিল নামে পরিচিত এবং এদের ক্যারোটিনোয়েড যৌগের মধ্যেও কিন্তু ফেলা যায়। এরা গাজরের কমলা রঙের জন্য দায়ী যে বিটা-ক্যারোটিন, সেই একই পরিবারের সদস্য। মুরগির খাবারের কারণেও কুসুমের রং পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন মুরগির খাবারে যদি বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ গাঁদা ফুলের পাপড়ি মিশিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ডিমের কুসুম হবে হলুদ বা কমলা। লাল পাকা মরিচের লাল রঙের জন্য দায়ী হচ্ছে ক্যাপস্যানথিন ও ক্যাপসরুবিন। মুরগি এ রকম পাকা লাল মরিচ খেলে তার ডিমের কুসুমের রং গাঢ় কমলা বা লাল হতে পারে।

ডিম রান্না!

কাঁচা ডিমে লম্বা প্রোটিন অণু স্বতন্ত্রভাবে পেঁচিয়ে থাকে। যখনই তাপ দেওয়া হয়, তখন এই প্যাঁচানো অণু খুলতে থাকে। প্রোটিন খুলে যখনই উন্মোচিত হওয়া শুরু করে, তখন এই প্রোটিন ত্রিমাত্রিক একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এই নেটওয়ার্কের মধ্যে আবার ছোট ছোট পকেট তৈরি হয়, ওতে আটকে পড়ে পানি। ফলে জিনিসটা তরল থেকে কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত হয়। ডিমের স্বচ্ছ প্রোটিন যে দলা বেঁধে অস্বচ্ছ হয়ে যায়, এর কারণ হচ্ছে প্রোটিনের সেই নেটওয়ার্ক।

ডিমের যে ডিমসুলভ গন্ধ, তার জন্য দায়ী হাইড্রোজেন সালফাইড। এই হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরি হয় মূলত ডিম রান্নার সময়—ডিমে যেসব প্রোটিনে সালফার থাকে, সেসব থেকে। একটা ডিম যত দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করা হবে, তত বেশি হাইড্রোজেন সালফাইড উৎপন্ন হয়। পুরোনো ডিম রান্না করতে গেলেও প্রচুর হাইড্রোজেন সালফাইড উৎপন্ন হয়।

কখনো কখনো ডিমের কুসুমের চারপাশে সবুজ একটা স্তর দেখা যায়, এখানেও ভূমিকা রয়েছে হাইড্রোজেন সালফাইডের। এ ঘটনার কারণ ডিমের কুসুমে থাকা আয়রনের সঙ্গে গ্যাসের রাসায়নিক বিক্রিয়া। কখনো কখনো দীর্ঘ সময় ধরে ডিম রান্না করলেও জিনিসটি দেখা যেতে পারে। ভয়ের কিছু নেই, স্তরটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। দীর্ঘ সময় সেদ্ধ করার পর বরফপানিতে ঠান্ডা করলেই এই স্তর আর দেখা যায় না।

ডিমের বয়সের ওপর নির্ভর করে ডিমের খোসা ছাড়ানো সহজ হবে, না কঠিন হবে। সময়ের সঙ্গে ডিমের ক্ষারত্বের পরিবর্তন হয়। ডিমের খোসায় হাজার হাজার সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে। এসব ছিদ্র দিয়ে কার্বন ডাই–অক্সাইড ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে এসে ডিমের সাদা অংশের pH–এর মান বাড়িয়ে দেয়। ডিমের pH অল্প হলে সাদা অংশ ডিমের খোসার ভেতরের অংশে শক্তভাবে লেগে থাকে। এ জন্য একেবারে নতুন ডিমের খোসা ছাড়ানো বেশ কঠিন কাজ। কাজটা সহজ হচ্ছে পুরোনো ডিমের ক্ষেত্রে।

নতুন ডিম সেদ্ধ করার সময় পানিতে বেকিং সোডা মিশিয়ে এই ঝামেলা দূর করা যায়। এতে ডিমের ভেতরের ক্ষারত্ব বাড়ে, যদিও সালফারের কটু গন্ধটাও সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। আবার সেদ্ধ করার সময় পানিতে লবণ মেশালে দ্রুত সেদ্ধ ও শক্ত হয়।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া

সূত্র: কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট