মসলার রসায়ন

মসলা নিত্যদিনের রসনার অপরিহার্য উপাদান। কী পুষ্টিমানে, কী খাদ্যের রূপ-রস-গন্ধ আরও ধারালো করতে, মসলা ছাড়া রান্নার কথা ভাবা যায় না। কিন্তু কী থাকে আমাদের অতি পিরচিত সব মসলাতে, যার জন্য রান্নার গুণমান পুষ্টি বহুগুেণ বেড়ে যায়?

রং, পুষ্টি, ঘ্রাণের বাইরেও, রোগ প্রতিরোধে মসলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মসলার ভেতরকার রসায়ন এবং সেসবের কার্যকারণ নিয়ে লিখেছেন মৌটুসী ইসলাম

জাফরান

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মসলার তকমা পেয়েছে এই জাফরান। কেশর বা স্যাফরন নামেও আমরা একে চিনি। Crocus sativus নামের গাছের ফুল থেকে সংগ্রহ করা হয় এই মসলা। ফুলের যে লালচে সোনালি গর্ভমুণ্ড বা স্টিগমা, সেটাই আসলে জাফরান। নির্দিষ্ট করে এই মসলার রং কেমন, তা বলা যায়a না। বলার প্রয়োজনও বোধ হয় নেই। কারণ নজরকাড়া জাফরানি রং নিজেই একটি আলাদা রঙের স্থান দখল করে আছে মানুষের মনে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর এই মসলা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে এই জাফরান কার্যকরী ভূমিকা রাখে। স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও জাফরান সাহায্য করে। প্রতিদিন ৩০ গ্রাম জাফরান খেলে বিষণ্নতা থেকে মুক্তি মিলবে।

কী রাসায়নিক উপাদান আছে এই জাফরানে?

১০০ রকমের রাসায়নিক উপাদান আছে এতে। স্যাফ্রানাল, ক্রোসিন, পিক্রোসিন এই উপাদানগুলো জাফরানের রং, গন্ধ আর হালকা তেতো স্বাদের জন্য দায়ী। ক্রোসিন আর ক্রোসিনের মতো আরেক উপাদান—ক্রোসেটিন—এই দুই উপাদানই জাফরানকে মহাশক্তিশালী মসলায় পরিণত করেছে। ক্রোসিন স্নায়ুকোষগুলোকে সতেজ রাখে, তাই বিষণ্নতা থেকে দূরে রাখে জাফরান। ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, জাফরান স্তন আর প্রস্টেট ক্যানসারের বিরুদ্ধেও কাজ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আমিরের গবেষণা দলের দাবি, ক্যানসার আক্রান্ত লিভার কোষের বিরুদ্ধে জাফরান দারুণ কাজ করে। জাফরানের ক্রোসিনকে তারা চৌম্বকীয় মাধ্যমে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। একই সময়ে যক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, পেট্রি ডিশ ও ইঁদুর—দুই ক্ষেত্রেই ক্রোসেটিন অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার কোষের বৃদ্ধিকে বন্ধ করতে পারে।

তাহলে দেরি না করে আজই নিয়মিত জাফরান খাওয়া শুরু করে দিন। প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৩০ গ্রাম। বাজারে যাওয়ার আগে টাকার বস্তা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলবেন না। তবে দামটা চড়া। এক কেজি কিনতেই লেগে যাবে বাংলাদেশি টাকায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা!

হলুদ

বাঙালির রসনার তৃপ্তি মেটায় এই হলুদ। তরকারির রং কড়া না হলে এ দেশের মানুষের চলেই না। তাই রান্নায় হলুদ আবশ্যকীয় উপাদান হয়ে গেছে। আবার রূপচর্চায়ও পিছিয়ে নেই এই হলুদ। বিয়ের আগে গাঁয়েহলুদ মাখিয়ে জমকালো অনুষ্ঠানের রেওয়াজ বহুকালের। চার হাজার বছর আগে থেকেই এই ঔষধি গুণাগুণের জন্য হলুদ বেশ। হলুদ আসলে আদাজাতীয় একধরনের গাছের মূল। এর মূল রাসায়নিক উপাদান কুরকুমিন। বেশির ভাগ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কুরকুমিনকেই দেখা গেছে রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে। কিন্তু কুরকুমিন নিয়ে গবেষণা বেশ কষ্টকর। কারণ এটি খুব অস্থিতিশীল আর পানিতে সহজে দ্রবীভূত হয় না। পানিতে দ্রবীভূত না হলে শরীরে এটি শোষিত হওয়ার কথা নয়। আসলে কুরকুমিন কোনো রাসায়নিক বাহকের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে দেহে শোষিত হয়। এই কুরকুমিন নানা রকম ক্যানসার সারিয়ে তুলতে পারে, যেমন মেলানোমা বা স্তন ক্যানসার। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ন্যানো কণাদের সঙ্গে কুরকুমিন যুক্ত করে দেখিয়েছেন, এটা নিউরোব্লাস্টোমা ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করতে পারে। যদিও এখনো আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক দল গবেষক ৪০ জন পূর্ণবয়স্ক আলঝেইমার রোগীকে নিয়ে গবেষণা করেন। ৪০ জনকে দৈনিক দুইবার ৯০ মিলিগ্রাম করে কুরকুমিনসমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্ট থেরাকুরমিন খেতে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১৮ মাস চলে এই গবেষণা। শেষে দেখা যায়, রোগীদের মস্তিষ্কে যে প্রোটিনগুলো প্লাক গঠন করত, তাদের পরিমাণ থেরাকুরমিন খাওয়ানোর পর অনেক কমে গেছে। রোগীদের স্মৃতিশক্তিও যথেষ্ট প্রখর হয়েছে। গবেষকদের মত, হলুদের স্বাভাবিক প্রদাহ দমনের ক্ষমতাই মস্তিষ্ককে রক্ষা করেছে। তাই নিজের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে আর প্রদাহ থেকে বাঁচতে প্রতিদিন অন্তত এক টেবিল চামচ হলুদ খান।

দারুচিনি

গাছের ফুল আর মূলের পর এবার গাছের বাকলকে মসলা বানানোর পালা। দারুচিনি, যা আমরা মসলা হিসেবে ব্যবহার করি, তা কিন্তু গাছের বাকল। হজমের সমস্যা সমাধান করতে বছরের পর বছর ধরে ঔষধি গুণের জন্য দারুচিনি বেশ সমাদৃত।

ক্যাসিয়া প্রজাতির দারুচিনি টাইপ ২ ডায়াবেটিসে বেশ কার্যকর। ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে খাবারের মেনুতে দারুচিনি যোগ করলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দারুচিনি হয়তো ইনসুলিন তৈরির কোনো এনজাইমের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়িয়ে রক্তে শর্করা কমায়।

দারুচিনির স্বাদ আর সুগন্ধ তৈরি করে সিনাম্যালডিহাইড নামের একধরনের রাসায়নিক উপাদান। এই রাসায়নিকের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রতিরোধী গুণ আছে। এ ছাড়া এটা অতিরিক্ত ওজনকে প্রতিহত করে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে সিনাম্যালডিহাইড সরাসরি মেদকোষের ওপর কাজ করে আর মেদ ঝরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। সিনাম্যালডিহাইড সরাসরি জিন লেভেলে কাজ করে ফ্যাট মেটাবলিজমের সঙ্গে জড়িত এনজাইমকে সক্রিয় করে তোলে। এ ছাড়া এটা মস্তিষ্ককেও সক্রিয় করে তোলে, আমাদের শেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। দারুচিনি CREB প্রোটিনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। এই প্রোটিন আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। মস্তিষ্কের আঘাতজনিত চিকিৎসায় সোডিয়াম বেনজোয়েট ব্যবহার করা হয়। দারুচিনি শরীরে হজম হয়ে এই সোডিয়াম বেনজোয়েট তৈরি করে। এভাবেই হয়তো সে মস্তিষ্কে কাজ করে। তবে অতিরিক্ত দারুচিনি কিন্তু ক্ষতিকর। দারুচিনি থেকে তৈরি হতে পারে কৌমারিন নামের উপাদান, যা যকৃতের ক্ষতি করে।

মরিচ

৬ হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে মরিচের চাষ শুরু হলেও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে আরও বহু বছর সময় লেগে যায়। মরিচের ঝাল স্বাদের জন্য ক্যাপসিসিন নামের উপাদান দায়ী। ক্যাপসিসিনের নির্যাস বর্ণহীন, গন্ধহীন। এই ক্যাপসিসিন মরিচ থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে ওষুধের কৌটায়। বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক অয়েন্টমেন্ট, নাকের স্প্রে, ত্বকের প্রদাহে এমনকি আত্মরক্ষাত্মক পিপার স্প্রেতে এই ক্যাপসিসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। নিউরোপেপটাইড সাবস্টেন্টস পিকে ক্যাপসিসিন ভেঙে ফেলে। এই পেপটাইড ব্যথার সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। চীনের একদল গবেষক বহু মানুষের ওপর বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছেন, যাঁরা সপ্তাহে একবার বা দুইবার মরিচ খান, তাঁরা দীর্ঘজীবী হন। আর প্রতিদিন মরিচ খেতে পারলে তো কথাই নেই। দীর্ঘায়ুর পাশাপাশি হবেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কারণ মরিচ আপনার ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। অস্ট্রেলিয়ান গবেষণায় দেখা গেছে, মরিচ উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ, মরিচের ক্যাপসিসিন নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন বাড়িয়ে রক্তনালিকে প্রসারিত করে।

আবার এই ক্যাপসিসিন টিউমার কোষের বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে। যেমন প্রস্টেট ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করতে পারে। যদিও ক্যানসার প্রতিরোধী ওষুধ হিসেবে ক্যাপসিসিনের ব্যবহার এখনো সীমাবদ্ধ। আমেরিকার বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ক্যাপসিসিনের ঝাল স্বাদ বাদ দিয়ে শুধু ঔষধি গুণ অক্ষুণ্ন রেখে নতুন কোনো উপাদান তৈরি করার।

শুধু ক্যাপসিসিনের কারণের মরিচ খেতে হবে এমনটা নয়। মরিচে আছে প্রচুর ভিটামিন এ আর সি। তাই মসলা খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও ধীরে ধীরে পাতে তুলুন মরিচ। বেশি ঝাল না খেতে পারার অজুহাত দূরে রাখুন। কারণ, মুখের যে রিসেপ্টরের জন্য ঝাল লাগে, সেগুলো ঝাল খেতে খেতে ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যায়। তখন আর ঝাল লাগবে না। আর একেবারেই মুখে তুলতে না পারলে ঝাল মরিচের বদলে বেছে নিন ক্যাপসিকাম।

আদা

হলুদ যে ধরনের গাছের মূল থেকে সংগ্রহ করা হয়, আদাও একই ধরনের গাছের মূল থেকে নেওয়া হয়। খ্রিষ্টের জন্মের আগেই ডায়রিয়া, বমিভাব আর পাকস্থলীর সমস্যায় আদার ব্যবহার ছিল। গ্রিকরাও আদা ব্যবহার করত। গর্ভবতীদের বমিভাব কমানোর জন্য কৃত্রিম ওষুধের বদলে আদা খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্যানসারের বিরুদ্ধেও আদা কাজ করে। আদার জিনজেরোল নামের উপাদানটি এর ঔষধি গুণের জন্য দায়ী। জিনজেরোলের আছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। ৬-জিনজেরোল এবং ১০-জিনজেরোল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, যাতে এদের ক্যানসার প্রতিরোধে কাজে লাগানো যায়। ৬-জিনজেরোল টাইপ ২ ডায়াবেটিসে কাজ করে। ইনসুলের পরিমাণ বাড়িয়ে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমায়। জাপানিজ গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে জিনজেরোল জিন পর্যায়ে কাজ করে শর্করার মেটাবলিজমকে বাড়ায়। জিনজেরোলের সঙ্গে কোয়েরসেটিন নামের একধরনের তিতা উপাদান মিলিয়ে ওষুধ বানানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এটা শুধু ডায়াবেটিস প্রতিকারই করবে না, সঙ্গে প্রতিরোধও করবে।

আদাকে তাপ দিলে শোগ্যাওল নামের এক পদার্থ তৈরি হয়। ৬-শোগ্যাওল প্রচলিত কেমোথেরাপির থেকে ক্যানসার চিকিৎসায় বেশি কার্যকরী বলে দাবি করেছেন ভারতের বিজ্ঞানীরা। গ্যাস্ট্রিক, কোলন বা মলাশয়ের ক্যানসার থেকে বাঁচাতে পারে এই ৬-শোগ্যাওল। তাই আজই প্রতিদিন কমপক্ষে দুই গ্রাম করে আদা খাওয়া শুরু করুন।