সেদিন মিলি অবশ্য চা খাইয়েছিল আমাকে। টংয়ে। চিনি বেশি ফ্যাতফ্যাতে চা। কিন্তু তা–ও তো চা...সঙ্গে মিলির কয়েক মিনিট থাকা।
আমার যে কবিতা লেখা বাড়ে, এর মধ্যে তা বলাই বাহুল্য। কবিতা দিতে আসাও বাড়ে। কিন্তু ছাপার সংখ্যা বাড়ে না। বাড়ে মিলির সখ্য। একদিন সে আমার একটা আস্ত কবিতা মুখস্থ বলে দেয়৷ যেটুকু বাকি ছিল, সেদিনই তা হয়ে যায় আমাদের—প্রেম!
কিন্তু প্রেমের জন্য আমাদের কারও অবস্থাই অত পোক্ত ছিল না। দুজনের কারও চাকরি নেই। কারও বাবা নেই। কারোরই বাবার রেখে যাওয়া বাড়ি নেই। ফলে টিএসসি থেকে পরীবাগ আমরা হাঁটি। চিলেকোঠা নেব ভেবে ভেবে সুখে মরে যাই। হাত ধরে গলে যাই। সন্ধ্যার দিকে প্যাটিস ও চুমু খাই।
এভাবেই হয়তো কেটে যেত; কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা তো আসলে জীবনেই ঘটে। তাই একদিন মিলি এল, জ্বর গায়ে। সঙ্গে নিয়ে এল অদ্ভুত একটা খবর। ব্যাংকে মিলির নাকি চাকরি হয়ে গেছে। খবরটা জানার পরই তার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। আমার মনে হলো আমারও জ্বর চলে আসবে…আমরা জ্বর নিয়ে রিকশায় ঘুরলাম অনেকক্ষণ। সম্ভবত জ্বরের ঘোরেই মিলি কাঁদে আমার কাঁধে মুখ গুজে। রাস্তার মানুষগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে।
দুই মাস পর আমরা সত্যিই একটা চিলেকোঠায় উঠে পড়ি। একটা ঘর, একটা জানালা, একটা দরজা এবং একটা ছাদ। আর একটা ছাদ মানে বোঝেন আপনারা…একটা সম্পূর্ণ নিজের আকাশ। আমরা তাতে টব আনি এবং ফুল ফোটাই। আমরা সেখানে বিকেলের চা খাই এবং সন্ধ্যায় গড়াগড়ি যাই। একটা পুরো রাত আমরা কাটিয়ে দিই শিশিরের শব্দ শুনে—নিজেদের জীবনানন্দ দাশ মনে হয়। আমরা ঘুমাই আকাশের গায়ে পা ছড়িয়ে।
আর এসবের মধ্যেই আমাদের ছাদটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ফেসবুক তো তখন চলে এসেছে। আমাদের সবকিছু আমরা ফেসবুকে দিই। আমাদের ভালো লাগার মুহূর্ত এবং আমাদের স্বস্তির বেঁচে থাকা। আমাদের ফুল ও প্রজাপতি; আমাদের সূর্য ডোবা। পরে খেয়াল করে দেখি আমরা আসলে আমাদের ছাদটাকেই নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দিয়েছি ওখানে। বুঝিনি, আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে ওই ছাদটা।
কিন্তু কে জানত, আমাদের মৃত্যুও হয়ে উঠবে ওই ছাদটা!
তবে সেই মৃত্যুটাকে আমি মুছে ফেলতে চাইছি। আমি জানি, আমি তা মুছে ফেলতে পারব। মৃত্যু মুছে ফেলা কঠিন কিছু নয়; যদি জীবন অন্য কোথাও থাকে!
তিন বছর আগে নিউইয়র্কের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান সাময়িকীতে একটা প্রতিবেদন বের হয়। সেখানে পাই আমি মেটাভার্সের প্রথম আভাস। পাই—বাস্তব জীবন আর ভার্চ্যুয়াল জীবনের একরৈখিক এক অবস্থান হতে পারে। ভার্চ্যুয়াল জীবনটাই হয়ে যেতে পারে বাস্তব জীবন। আমার সেই জীবনটা খুব প্রয়োজন, কারণ শ্রাবণের এক রাতে আমি আমার চূড়ান্ত বাস্তবতাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম!
দূর্বা ফুল যে এত সুন্দর হতে পারে, আমার কোনো ধারণা ছিল না।
মাটির বড় একটা পাত্রে মিলি লাগিয়েছিল দূর্বাগুলো। বর্ষায় পাতাগুলো এমন লকলকিয়ে উঠল যে মনে হলো এর চেয়ে স্বর্গীয় কিছু সৃষ্টি হতে পারে না পৃথিবীতে!
দূর্বাদের যেন এ কথায় মন খারাপ হলো। ফলে আমাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই কয়েক দিনের মধ্যে ফুটিয়ে ফেলল লাল লাল দূর্বা ফুল। কী অদ্ভুত সুন্দর! কী অসম্ভব সুন্দর!
মিলিকে বললাম, দেখো, ছুঁয়ে দেখো ফুলগুলো…কবিতার চেয়েও ওরা সুন্দর!
মিলি এগিয়ে গেল বড় টবটার দিকে। কার্নিশ বেয়ে ছড়িয়ে রয়েছে ফুলগুলো। মিলি সেগুলো ছুঁতে চাইল, কিন্তু ঠিকমতো ছোঁয়ার আগেই পিছলে গেল তার পা।
আমার হাত ধরতে চাইল মিলি, কিন্তু আমি তা সময়মতো বাড়াতেই পারলাম না। শেওলা তাকে টেনে নিয়ে গেল অনেক দূর। তারপর নিউটনের সূত্র মেনে মিলি ৯ তলার ওপর থেকে আছড়ে পড়ল রাস্তায়।
আমাকে সিঁড়ি ভাঙতে হলো। আমাকে কলাপসিবল গেট খুলতে হল। আমাকে একটা ভাঙা ড্রেন লাফাতে হলো, তারপর রক্তেভাসা মিলিকে পেলাম আমি। কিন্তু মিলি তখন সেখানে ছিল না। মিলি আর কোথাও ছিল না।
কিন্তু মিলি আছে, আমার সঙ্গে আছে…আমাদের এই ছাদে আছে!
আর এই মিলি, আমাদের ছাদ আছে ফেসবুকে...ভার্চ্যুয়াল জগতে। সেখানে মিলির মৃত্যু হয়নি। সেখানে মিলির ছবি, মিলির ভিডিও, মিলির সময় সব যদি থাকে, তাহলে মিলি থাকবে না কেন?
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সেই জার্নালে পড়া মেটাভার্সের বিষয়ে পড়ার পর থেকেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। কীভাবে কাজ করছি তা বলার এখনো সময় আসেনি। কিন্তু আমি জানি সময়টা চলে আসবে যেকোনো দিন! আর তারপর আমি আপনাদের সামনে প্রকাশ তা করব, যা এখন পর্যন্ত ঘটেনি পৃথিবীতে, অথবা ঘটলেও আমরা কেউ জানি না।
২
প্রকাশক শাহেদ মনজুর এবার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তরুণ পাঁচ কবি ও তরুণ পাঁচ ঔপন্যাসিকের বই প্রকাশ করতে চান তিনি। জামানকে ডেকেছেন এই উদ্দেশ্যেই। জামান দীর্ঘদিন পত্রিকার সম্পাদক। কবি-সাহিত্যিকদের খোঁজ তার কাছ থেকে পেতে চান শাহেদ মনজুর। চা ও সমুচার পর আসেন মূল আলোচনায়—
‘দশটা ভালো কবি-সাহিত্যিক দ্যান জামান ভাই। ফ্রেশ। বই করব ওদের।’
জামান সিগারেট ধরিয়ে হাসে শুধু। বলে, চাইলেই কি আর পাবেন নাকি! ভালোর অভাব বহুত দিনের। চলনসইও নাই ঠিক করে…
‘আপনি কিন্তু অনেক দিন থেকেই কয়েকটা নাম বলতেন…! রফিক আরেফিন, মৃদুল বিপ্লব, তারপর হাসান মাহমুদ…’
‘হাসানকে দেখি আপনিও মনে রেখেছেন...হুম, ভালো লিখত সে!’
‘লিখত মানে? লেখা ছেড়ে দিয়েছে?’
‘ছেড়ে দিয়েছে কি না জানি না...কিন্তু প্রকাশ তো করতে দেখি না। আমার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই বললেই চলে!’
‘মানে কবিতার শহীদ?’
‘হতে পারে, না–ও পারে। শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে…তার বউয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল!’
‘বিয়া করলে কবিতা শেষ, না?’
জামান হাসে। বলে, ‘আমি তো বিবাহিত। কবিতা শেষ হয়নি কিন্তু আমার। তবে হাসানের ব্যাপারটা অন্য রকম। ও যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, যার নাম বলছিল, যার হাত ধরেছিল…বাস্তবে আসলে কেউ ছিল না তার পাশে!’
শাহেদ মনজুর লাফিয়ে ওঠে প্রায়—দাঁড়ান দাঁড়ান! পাশে কেউ ছিল না মানে?
পরপর দুইবার সিগারেটে টান দেয় জামান। কাচের দেয়াল পেরিয়ে যায় তার দৃষ্টি—আমার ধারণা, হাসানের কারও সঙ্গে বিয়ে হয়নি। মিলি বলে যার কথা বলছিল সে… সেই মেয়েটি আসলে বাস্তবে ছিল না!
‘তাহলে কি পরাবাস্তব? শোনেন, লাতিন কপচায়েন না তো!’
‘অতিবাস্তবও তো হতে পারে কিংবা অন্যবাস্তব!’
‘জিন-ভূত বা পরাবাস্তব...এই তো আপনাদের সাহিত্য, এর বাইরে আবার অন্যবাস্তব এল কোথা থেকে?’
‘সময় বদলে যাচ্ছে, সাহিত্যও তো বদলাবে, কারণ সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবন বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার বাস্তবতাও…!’
‘খুব হয়েছে। হাসানকে মনে রেখেছিলাম; কারণ ওর দু–একটা কবিতা পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল ও সম্ভাবনাময়। কিন্তু ও যদি না থাকে…মানে বাস্তব-পরাবাস্তব-অতিবাস্তব-অন্যবাস্তব সব যদি গুলে খায়, তাহলে আর ওকে আমার দরকার নেই! অন্য কারও নাম বলেন…’
উঠে দাঁড়ায় জামান। হাসান সম্পর্কে আরও কিছু খবর সে গত কয়েক বছরে পেয়েছে। জেনেছে মিলি নামের এক কাল্পনিক মেয়ের সঙ্গে সে নাকি চিলেকোঠায় থাকে। সেখানে তার একার সংসার। হাসানের নিতান্ত পাগলামি ভেবে জামান ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে পারে; কিন্তু কেন কে জানে, জামান কখনোই বিষয়টা উড়িয়ে দিতে পারেনি। হাসানের সেদিনের ব্যবহার, মিলিকে নিয়ে তার উচ্ছ্বাস, একসঙ্গে বসিয়ে চা খাওয়া—কোথাও জামান উন্মাদনা দেখেনি। জামানের শুধু মনে হয়েছিল হাসান যেন অন্য এক বাস্তবতার সঙ্গে বসবাস করছে।
কিন্তু এত কথা প্রকাশককে বোঝানোর প্রবৃত্তি হয় না জামানের। সে বরং তরুণ সাহিত্যিক খোঁজায় মন দেয়।
৩
আজ রাতেই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে, বারবার এমনটাই মনে হচ্ছে আমার।
ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া আর বাস্তব জগতের ভেতর আমার যে দূরত্ব ছিল, ক্রমেই তা কমে এসেছে। এখন দুটো জগৎ এমন একটা জায়গায় এসে মিলেছে, তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। বিষয়টা সুখের। কিন্তু সুখের চাইতেও আমার অস্বস্তি হচ্ছে। যেন দম আটকে আসছে। অথচ আমি বসে আছি চিলেকোঠার ছাদে। ওপরে অন্ধকার আকাশ। আর তাতে জরিফুল হয়ে ফুটে আছে অসংখ্য তারা। বাতাস হচ্ছে মৃদু। এমন আবহাওয়ায় কারও দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে?
ভার্চ্যুয়াল আর বাস্তব জগতের ব্যবধান মুছে গেলে আমার জগতে মিলি আবার প্রবেশ করবে। আমরা আবার ছাদবাগান নিয়ে মেতে উঠব। আবারও সূর্যমুখী ফোটাব টবে। আবারও বৃষ্টিতে ভিজব সারাটা বিকেল। আবার একসঙ্গে চা, একসঙ্গে আকাশের দিকে মেলে দেওয়া পা…
ল্যাপটপটা ভাঙা বটে আমার। সেটার জ্বলে যাওয়া পর্দায় উঠে আছে মিলির অ্যাকাউন্ট। নীল শাড়ির ছবিতে মিলি হাসছে মুক্তা ঝরিয়ে। আমরা কি খুব কাছাকাছি মিলি?
আমরা কি মাত্র একটা enter থেকে দূরে?
বোতামে চাপ দিই আমি এবং কিছুই ঘটে না। পর্দায় শুধু কিছু নম্বর ওঠে। আমি আরও কয়েকবার চাপ দিই বোতামে। কিন্তু কোনো লাভই হয় না শেষ পর্যন্ত।
হতাশ লাগে না আমার, কিন্তু ক্লান্তি আসে খুব। ছাদের ওপরই শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে আকাশে পা রেখে ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু চাইলেই কি আর আকাশে পা রাখতে পারি আমি? চাইলেই যেমন মিলিকে আমার জগতে নিয়ে আসতে পারি না।
ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম হয়তো।
চোখ খুলে দেখি আকাশটা ঠিক আগের মতোই ঝুলে আছে মুখের ওপর। সেই তারা, সেই আধভাঙা চাঁদ, আর ফ্যাকাশে কালো মেঘ। তাহলে কিছুই বদলায় না আসলে? তাহলে পাশাপাশি এই ভার্চ্যুয়াল জগৎটা শুধুই একটা মিথ্যা, একটা ধাঁধা—একটা কুহক!
একচিলতে আমার ঘর। আকাশ ছেড়ে আমাকে সেখানেই যেতে হয়। কাল থেকে হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব আমি। কবিতা লিখব, যাব জামান ভাইয়ের কাছে, বলব, দেখেন তো কবিতাটা ছাপানো যায় কি না!
দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকি আমি। আর ঢুকতেই দেখি কেউ একজন ঘুমিয়ে আছে। কাঁথা টেনে দেওয়া আছে শরীরে—বুকের ভেতরটা যেন লাফিয়ে ওঠে এবার...মিলি! নিশ্চয়ই মিলি!
মানে ভার্চ্যুয়াল জগতের অস্তিত্ব সত্যি আছে! মানে সেই জগৎ থেকে আমি মিলিকে আমার জগতে নিয়ে আসতে পেরেছি!
ডাক দিই আমি—মিলি! মিলি!
মিলি মুখ ফিরিয়েই থাকে। এবার তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনিই দিই যেন…মিলি…এই মিলি…
শরীরটা ঘুরে যায়। তাকায় আমার দিকে। যেন আয়না!
আমিই তাকিয়ে আছি আমার দিকে। আমিই আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসি। আমাকে ওই আমিটা বলে, আমি ভার্চ্যুয়াল হাসান মাহমুদ। তুমি নিশ্চয়ই তোমার বাস্তবেরটা?