ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, স্বেচ্ছাসেবী ও অতিথিসহ নানা বয়সের মানুষের আগমনে বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে উৎসবের আমেজ। বিকেল ৪টা থেকেই তাঁরা আসতে শুরু করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা গেল, ভরে গেছে দশ তলার কনফারেন্স রুমের সব কটি আসন। এই জমজমাট আয়োজনই বলে দিচ্ছে, বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার নবম জন্মদিন নিয়ে সবার কত আগ্রহ।
আজ ১৫ অক্টোবর, বুধবার বিজ্ঞানচিন্তার নবম জন্মদিন, দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অর্থাৎ নয় বছর পূর্ণ করল বিজ্ঞানচিন্তা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষেই এই বিশেষ আয়োজন। এবারের প্রতিপাদ্য—বিজ্ঞান আছে সবখানে।
শুরুতেই শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম। তিনি বিজ্ঞানচিন্তার এই নয় বছরের সফল পথচলার কথা উপস্থিত সবার সামনে তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে এই দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘সবাইকে বিজ্ঞানে সচেতন করে তুলতেই আমরা বিজ্ঞানচিন্তা শুরু করেছিলাম। সব সময় আমার মাথায় নানা প্রশ্ন আসত। আমার মনে হতো, সবার মাথায়ই হয়তো এরকম অনেক প্রশ্ন আসে। তারপর আলাপ-আলোচনা করে আমরা এই ম্যাগাজিনটা শুরু করলাম, যাতে সবাই সবার প্রশ্নের উত্তর পায়। আমরা চাই, শিক্ষার্থীরা যেন গোটা বিশ্ব থেকে কোনোভাবে পিছিয়ে না থাকে।’
এরপর বক্তব্য রাখেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। তিনি বলেন, ‘প্রথম আলোর অনেকগুলো জানালা আছে, বিজ্ঞানচিন্তা সেই জানালাগুলোর একটি। বিজ্ঞানচিন্তাকে সফল করার জন্য এর সব পাঠককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষ করে, আমাদের তরুণ পাঠকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই বিজ্ঞানচিন্তার সব বন্ধুদের।’
অতিথিদের বক্তব্যের মাঝখানে মাঝখানে পাঠকেরাও তাঁদের মতামত দেন। বিজ্ঞানচিন্তার নিয়মিত পাঠক দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসারা জামান বিজ্ঞানচিন্তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো এখন আমি খুব সহজেই বুঝতে পারি। প্রতিমাসে বিজ্ঞানের সব নতুন তথ্য পাওয়ার নির্ভরযোগ্য উপায় হলো বিজ্ঞানচিন্তা।’
এরপর কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানচিন্তার শুরু থেকেই আমি মূলত জীববিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে আসছি। এখন বিজ্ঞানচিন্তার সবগুলো বিভাগেই বেশ কিছু ভালো লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। আমার বিশ্বাস, এই লেখাগুলো পাঠকদের অনেক ভালো লাগবে।’
এরপর রম্যলেখক এবং উন্মাদ-এর সম্পাদক আহসান হাবীব তাঁর বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো নিয়মিত বিজ্ঞানচিন্তার লেখক। প্রতি সংখ্যায় বিজ্ঞান রম্য তো থাকেই, মাঝেমধ্যে কল্পগল্পও লিখি। বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আবদুল কাইয়ুমকে ধন্যবাদ। এতদিন ধরে বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদনার দায়িত্ব সফলভাবে পালন করার জন্য তাঁকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা।’
বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাফিফা জামাল বলেন, ‘বাজারের চাহিদার কারণে আমাদের দেশে আগের চেয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা খানিকটা হয়তো বেড়েছে; তবে দুঃখের বিষয় হলো, শিক্ষার মান তেমন ভালো না। এই বিষয়টির দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। দায়িত্বশীলদের এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সেই সঙ্গে পাঠকদের কথা ভেবে বিজ্ঞানচিন্তারও আরও কিছু করা উচিত।’
বিজ্ঞানবক্তা আসিফ বলেন, ‘বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্যান্য বিষয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম এমনভাবে তৈরি হয় যে তারা অন্ধকার দূর করার জন্য কাজ করবে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎকৌশল ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। মজার ছলে তিনি বলেন, ‘সবাই প্রশংসা করলে তো হবে না, খানিকটা সমালোচনাও করা প্রয়োজন।’ এরপর তিনি মনে করিয়ে দেন, বিজ্ঞানচিন্তা যেহেতু বড় হচ্ছে, তাই তার দায়িত্বও বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘শুধু বিজ্ঞানবিষয়ক সংবাদ বা সহজ লেখা থাকবে না, বৈজ্ঞানিক চিন্তা করতে শেখায়, এমন লেখাও বিজ্ঞানচিন্তাকে প্রকাশ করতে হবে। প্রয়োজনে সমীকরণও যুক্ত করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা সত্যিকারের বিজ্ঞানটুকুর সঙ্গে পরিচিত হবে, এর ভেতরে ঢুকতে পারবে তারা।’
ছবি: জাহিদুল করিমএরপর কথা বলেন ছড়াকার ও চিকিৎসক রোমেন রায়হান। তিনি জানান, বিজ্ঞানচিন্তার প্রথম সংখ্যা থেকেই তিনি নিয়মিত ছড়া লিখে আসছেন। প্রথম ছড়াটির নাম ছিল ‘হজম’। মজার ছলে তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এরপর আর ওরা আমাকে লিখতে বলবে না, কিন্তু এখনো আমি লিখছি।’ এই দীর্ঘ পথচলার স্মৃতিচারণও করেন তিনি, শোনান বেশ কিছু মজার গল্প।
লেখক ও গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক তানজিনা হোসেন এরপর বলেন, ‘বিজ্ঞানচিন্তা এই দীর্ঘ সময়ে এত বিপুল সংখ্যক পাঠক তৈরি করেছে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। বিজ্ঞানচিন্তা দেশে নতুন নতুন পাঠক তৈরি করছে। তবে অনেকে যেমন বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার কথা বলছেন, আমি এ ব্যাপারে একটু ভিন্নমত পোষণ করি। আমি বলতে চাই, সবাই হয়তো বিজ্ঞানী হবেন না, কিন্তু সবারই বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আমাদের নৈতিক মানুষ গড়তে আরও কাজ করতে হবে। বিজ্ঞানীদেরও মানবিক হতে হবে।’
বিকাশ লিমিটেডের রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্কুল শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে সারা দেশে বিকাশ ও বিজ্ঞানচিন্তা যৌথভাবে বিজ্ঞান উৎসব আয়োজন করছে। সামনেও আমরা এভাবে কাজ করতে চাই। বিজ্ঞানচিন্তাকে ধন্যবাদ।’ বক্তব্যের পাশাপাশি বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এবং নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসারের হাতে বিকাশের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা স্মারকও তুলে দেন তিনি।
কার্টুনিস্ট নাসরীন সুলতানা মিতু বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জন্যও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। এই কাজটি সুন্দরভাবে করে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞানচিন্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এআই দলের দলনেতা ও অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘সমালোচনা ও পর্যালোচনার মাঝে আমি বলতে চাই, আমার বাচ্চাদের জন্য বিজ্ঞানচিন্তা একটি নির্ভরশীল বিজ্ঞান পত্রিকা। বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়কে সহজ করে সবার সামনে তুলে ধরা অনেক কঠিন কাজ। বিজ্ঞানচিন্তা সেই কাজটি সফলভাবে করে যাচ্ছে। আমার বাচ্চাদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো এমন মানসম্পন্ন একটি পত্রিকা বের করার জন্য বিজ্ঞানচিন্তা টিমকে ধন্যবাদ।’
সবার শেষে সমাপনী বক্তব্যে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘বিজ্ঞানচিন্তা আমাদের এক অসাধারণ প্রতিবেশী। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলোকে সহজ করে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য বিজ্ঞানচিন্তার কর্মীরা যেভাবে পরিশ্রম করে, তা সত্যিই প্রশংসার। আমি আশা করি, বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের মধ্য থেকেই একদিন কেউ নোবেল পুরস্কার জিতবে।’
এরপর গানে মেতে ওঠে সবাই। ‘আপনঘর’ ব্যান্ডের গানে মুখরিত হয়ে ওঠে সভাকক্ষ। গান পরিবেশন করেন ব্যান্ডের চার সদস্য সৈয়দ মিজান, শাহনেওয়াজ তুষার, জাকারিয়া শেখ এবং অনিক সরকার। এরপর রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। গান শেষে শুরু হয় অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ—পাঠকদের জন্য উপস্থিত বিজ্ঞান কুইজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে ওঠে কুইজ প্রতিযোগিতা। প্রশ্নোত্তর পর্বে অনেকের মজার ভুল উত্তরে যেমন সম্মিলিত হাসির রোল ওঠে, তেমনই সঠিক উত্তরদাতাদের জন্য ছিল বিশেষ পুরস্কার।
বিজ্ঞানচিন্তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সম্মাননা দেওয়া হয় সেরা ছয় স্বেচ্ছাসেবীকে। সেরা নবীন স্বেচ্ছাসেবক কর্মী মনোনীত হয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌস; বর্ষসেরা স্বেচ্ছাসেবক আহসান হাকিম, খাদিজা খান এবং মাহমুদুল হাসান; সেরাদের সেরা স্বেচ্ছাসেবী ও কর্মী বেলায়েত হোসেন এবং সেরা কর্মী নির্বাচিত হয় আসহাবিল ইয়ামিন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন অভিনয়শিল্পী শানারেই দেবী শানু, বিজ্ঞানচিন্তার মুদ্রণ ব্যবস্থাপক শামসুল হক, সহসম্পাদক কাজী আকাশসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ।
সবশেষে বিজ্ঞানচিন্তার নয় বছরের সফল পথচলার সঙ্গী বিজ্ঞাপনদাতাদের, বিশেষ করে বিকাশ, রকমারি ও সিটি ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উপস্থিত সবাই করতালি দেন। অতিথি ও পাঠকদের নিয়ে কাটা হয় কেক। সবশেষে ফটোসেশনের মাধ্যমে শেষ হয় এ আয়োজন।
আব্দুল কাইয়ুমের সম্পাদনায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে আত্মপ্রকাশ করে বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা। এ পর্যন্ত ম্যাগাজিনটির ১০৬তম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা প্রকাশের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে বিজ্ঞানচিন্তা নিয়মিত আয়োজন করছে বিজ্ঞান উৎসব, বিজ্ঞান বক্তৃতা, বিজ্ঞান মেলাসহ আরও অনেক কিছু।