ঘড়ির কাঁটা বিকেল ৪টা ছুঁই ছুঁই। বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয় মানুষে পরিপূর্ণ। বিকেল ৩টা থেকেই তাঁরা আসতে শুরু করেছেন। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই দেখা গেল, তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
এ আয়োজন বিজ্ঞানচিন্তার জন্মদিনের আয়োজন। পাঠককে সঙ্গে নিয়ে এই জন্মদিন উদ্যাপন করবে ম্যাগাজিনটি। ১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার বিজ্ঞানচিন্তার ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। নতুন দিনের বিজ্ঞান—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আট পেরিয়ে নয়ে পা রাখল বিজ্ঞানচিন্তা। এ উপলক্ষে বিজ্ঞানচিন্তার পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, স্বেচ্ছাসেবী ও অতিথিসহ নানা বয়সের মানুষ এক হয়েছেন এখানে।
শুরুতেই শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘বিজ্ঞানচিন্তা আমাদের প্রতিবেশী। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো সহজ করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে বিজ্ঞানচিন্তার কর্মীরা যেভাবে পরিশ্রম করে, তা প্রশংসার দাবিদার।’ কৌতূক করে তিনি বলেন, ‘আমি তো কিশোর আলোর সম্পাদক, তাই বিজ্ঞানচিন্তার সাফল্য নিয়ে আমি খানিকটা ঈর্ষান্বিতও বটে!’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিজ্ঞানচিন্তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখক আহসান হাবীব, বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াডের কোচ ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন, ছড়াকার ও চিকিৎসক রোমেন রায়হান, বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস ও মেকাট্রনিকস বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, বিজ্ঞানবক্তা আসিফ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সৌমিত্র চক্রবর্তী, প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও লেখক তানজিনা হোসেন, শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার আখতার হুসেন, কার্টুনিস্ট নাসরিন সুলতানা মিতু, কার্টুনিস্ট মেহেদী হক, গীতিকার কবির বকুল, কথাসাহিত্যিক জাভেদ হুসেন, মশিউল আলম, আদনান মুকিত, মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের কর্মকর্তা সায়মা আহসান, মাহবুবুর রহমান শাকিল, বিজ্ঞানচিন্তার মুদ্রণ ব্যবস্থাপক শামসুল হক, নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসারসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
২০২৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গবেষণায়। আর জীববিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে মাইক্রোএমআরএনএ। সবই যেন বিজ্ঞানের নতুন যুগের কথা ঘোষণা করছে। এ কথাই যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিজ্ঞানচিন্তার ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্যে: নতুন দিনের বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই নতুন সময়ের কথাই উঠে এসেছে আয়োজনে বক্তাদের কথায়।
অধ্যাপক আরশাদ মোমেন পদার্থবিজ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় প্রচুর ডেটা তৈরি হয়। সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার কণাত্বরক যন্ত্রে দুটি প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটালে প্রায় ১০ হাজারের মতো কণা নির্গত হয়। আগে এসব কণার বৈশিষ্ট্য ও গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে মানুষের সাহায্য নিতে হতো। প্রচুর সময় ব্যয় হতো এতে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে এসব ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়। বিজ্ঞান গবেষণায় বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা ও চ্যালেঞ্জের দিকটি ফুটে ওঠে অধ্যপক লাফিফা জামালের বক্তব্যে। বিজ্ঞানচিন্তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন টুলসে পরিণত হয়েছে। রোগ নির্ণয়ে ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার বাড়ছে। তবে বাংলাদেশের জন্য সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো, আমরা দেশে যথেষ্ট ডেটা পাই না। দেশের রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য দেশীয় ডেটা প্রয়োজন। পাশাপাশি ডেটাবেজ তৈরি ছাড়াও ডেটা সিকিউরিটি নিয়ে কাজ হওয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞানচিন্তা এসব ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।’
দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গবেষণায় আশাব্যঞ্জক দিক উঠে আসে সৌমিত্র চক্রবর্তীর কথায়। তিনি জানান, ‘ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগে রোগীদের বিভিন্ন কোষের ছবি বিশ্লেষণের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে অল্প সময়ে প্রচুর ডেটা তৈরি হচ্ছে। এর সাহায্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে, যা কাজে লাগবে ভবিষ্যতে রোগ নির্ণয়ে।’
বিজ্ঞানের নানা দিক নিয়ে আলোচনার ফাঁকে সভাকক্ষে আসেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখাগুলো আরও সহজ ভাষায় পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জোর দিতে চাই যে কিশোররাও যেন এ ম্যাগাজিনের লেখা পড়ে সহজে বুঝতে পারে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তবে বিজ্ঞানচিন্তার সেটা করতে হবে।’
বিকাশ কর্মকর্তা সায়মা আহসান বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে আছি আমরা। দেশের শিশু-কিশোরদের কাছে বিজ্ঞান ছড়িয়ে যাবে, সেটাই আমার প্রত্যাশা। সে জন্য বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে বিজ্ঞান উৎসব আয়োজন করছি। বিজ্ঞানচিন্তার আরও দীর্ঘায়ু ও সাফল্য কামনা করি।’
অনুষ্ঠান চলাকালে সভাকক্ষে হাজির হন আয়েশা। আন্তর্জাতিক মেয়ে শিশু দিবস উপলক্ষে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বিশেষ কর্মসূচী ‘গার্লস টেকওভার’-এর অংশ হিসেবে প্রথম আলোর একদিনের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। বিজ্ঞানচিন্তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানান এ দিনের সম্পাদক।
রম্য লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সময়ে নানান বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিনে লিখেছেন, এঁকেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান প্রজন্ম বিজ্ঞান বিষয়ক কমিক্সেও অনেক আগ্রহী।
বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার ওপর জোর দেন ছাড়াকার ও চিকিৎসক রোমেন রায়হান।
চিকিৎসক ও কল্পবিজ্ঞান লেখক তানজিনা হোসেন বলেন, একসময় মহাকাশবিষয়ক কল্প বিজ্ঞান লেখা বেশি দেখা যেত। এখন হয়তো সেখানে এআই আসবে।
এ ছাড়াও আখতার হুসেন, কবীর বকুল, বিজ্ঞানবক্তা আসিফ, নাসরীন সুলতানা মিতুসহ আরও অনেকে শুভেচ্ছা জানান বিজ্ঞানচিন্তাকে। শুভেচ্ছা জানান পাঠকেরাও।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসারা জামান বিজ্ঞানচিন্তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো এখন তিনি বেশ সহজেই বুঝতে পারেন।’
সবশেষে সমাপনী বক্তব্য দেন বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বিজ্ঞানের পত্রিকা বের করার চিন্তা করি, তখন দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম—এটা কাদের জন্য করব। পরে ঠিক করি, শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবার জন্য হবে এ পত্রিকা। এখানে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে যেমন লেখা রয়েছে, তেমনি ছোটদের জন্যও রয়েছে নানা আয়োজন। বিজ্ঞান কমিকস বা ছড়া-কবিতার মাধ্যমে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজ করে তুলে ধরা হয়। আগামীদিনে আমরা আরও বেশি মানুষের কাছে বিজ্ঞানের কথাগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই।’
এরপর শুরু হয় পাঠকদের জন্য উপস্থিত বিজ্ঞান কুইজ। বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফের পরিচালনায় প্রশ্নোত্তর পর্বে অনেকের ভুল উত্তরে জমে ওঠে কুইজ। সঠিক উত্তরদাতাদের জন্য ছিল বিশেষ পুরস্কার। বিজ্ঞানচিন্তার আট বছরের পথযাত্রায় সঙ্গী বিজ্ঞাপনদাতা, বিশেষ করে বিকাশ, রকমারি ও সিটি ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞতাসূচক তালি দেন সব পাঠক।
এরপর বিজ্ঞানচিন্তার থিম সং গাওয়া হয়। অতিথি ও পাঠকদের নিয়ে কাটা হয় কেক। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলে বিজ্ঞানচিন্তার থিম সং, ‘কাগজের মলাটে জ্ঞানের তল্লাটে আটকে রাখে সারা দিনটা, বিজ্ঞানচিন্তা।’ সব শেষে ফটোসেশনের মাধ্যমে শেষ হয় এ আয়োজন।
আব্দুল কাইয়ুমের সম্পাদনায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে আত্মপ্রকাশ করে বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা প্রকাশের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে বিজ্ঞানচিন্তা নিয়মিত আয়োজন করছে বিজ্ঞান উৎসব, বিজ্ঞান বক্তৃতা, বিজ্ঞান মেলাসহ আরও অনেক কিছু। এ পর্যন্ত ম্যাগাজিনটির ৯৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘নতুন দিনের বিজ্ঞান’-এ প্রতিপাদ্য নিয়ে ম্যাগাজিনটি ছাপা সংস্করণের বাইরে, অনলাইনেও নিয়মিত প্রকাশ করছে আপডেট, ফিচারসহ আরও অনেক কিছু।