৭ পেরিয়ে বিজ্ঞানচিন্তা
বিজ্ঞানচিন্তা দীর্ঘজীবী হোক
আজ ১৫ অক্টোবর, বিজ্ঞানচিন্তার জন্মদিন। ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে বিজ্ঞানচিন্তা। সময়ের আবর্তে ৭ পেরিয়ে আজ আটে পা রাখল। এ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নিয়মিত লেখক ও বাংলাদেশ জাতীয় পদার্থবিজ্ঞান দলের কোচ আরশাদ মোমেন।
বেশ কিছুদিন ধরে বিজ্ঞানচিন্তায় লেখা হচ্ছে না। সেই অপরাধবোধ থেকে মনে হলো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কিছু একটা লিখি। কিন্তু কী নিয়ে লিখব, সেটা কদিন ধরেই আমাকে ভাবাচ্ছিল।
কিছুদিন আগে নতুন শিক্ষা কার্যক্রমের অধীন স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য লেখা বিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলোর কিছু অংশ পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাতে মনে হলো, বইয়ের রচয়িতারা তাঁদের কাজে বেশ আন্তরিক। কীভাবে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞান বিষয়টিকে আরও আকর্ষণীয় করা যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। তবে দেখলাম, বেশ কটি জায়গায় তাঁরা এ দেশে চালু কিছু চিন্তাভাবনার উর্ধ্বে উঠে একবিংশ শতাব্দীর জন্য প্রয়োজনীয় ধারণা ব্যবহার করেননি। বরং পুরোনো উনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাধারায় আটকে রয়েছেন। কেউ হয়তো যুক্তি দিতে পারেন যে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এসব ধ্যান-ধারণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় থাকা প্রয়োজন। এই যুক্তি যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান প্রজন্মকে স্মার্টফোনের সঙ্গে পরিচয় না করিয়ে বরং টমাস আলভা এডিসনের ব্যবহার করা টেলিফোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। আসলে, সবজায়গায় ঐতিহাসিক ধারণার অবতারণা করার চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়।
আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা এমন হওয়া উচিত যেন শিক্ষার্থীরা একটি সমন্বিত ধারণা নিয়ে সামনে এগোতে পারে। যেমন অণু-পরমাণুর গঠন পড়ানোর জন্য ডাল্টনীয় চিত্রের অবতারণা করার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধারণার মানসিক চিত্রটা মাথায় আঁকতে শুরু করতে হবে, যা আবার পরে মুছে ফেলতে হবে না। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা ধারণাগুলো যেভাবে শেখাচ্ছি, তাতে মনে হয়, ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে শেখানো জ্ঞানের মধ্যে কিছু সাংঘর্ষিক ধারণা রয়ে গেছে। একটা সহজ উদাহরণ টেনে আমার বক্তব্যের অনুকূলে প্রমাণ দাঁড় করাতে চাই।
আমার প্রথম প্রশ্ন, তাপ বলতে আমরা কী বুঝি? এককালে মানুষ তাপকে একধরনের তরল বা বায়বীয় পদার্থের মতো কিছু একটা মনে করত। ঐতিহাসিকভাবে ঘাঁটলে দেখা যায়, একে ফ্লজিস্টন (Flogiston) নামে ডাকা হতো। পরে পদার্থের আণবিক গঠনের ধারণা প্রচলিত হয়। এরপর আমরা বুঝতে পারি, তাপ আসলে পদার্থের অণুর বিক্ষিপ্ত গতির পরিমাপ। এটা বোঝাতে গেলে আমাদের আবার আরেকটু পেছাতে হবে। আমরা জানি, হাতের মুঠোয় একটা ছোট পাথর ধরে যদি সেটাকে ছুড়ে মারি, তার ভেতর গতিশক্তি থাকবে। এখন কাউকে যদি বলা হয়, চলমান অবস্থায় এই নুড়ির গতিশক্তি কত, তাহলে সে সহজেই ভর ও বেগের মান জেনে নিয়ে সূত্রের সাহায্যে গতিশক্তি বের করতে পারবে। এই পরিমাপের জন্য আমাদের মাত্র দুটো সংখ্যা জানতে হচ্ছে—পাথরের ভর ও দ্রুতি (অর্থাৎ, বেগের মান)। সমস্যা হলো, আমরা যদি আণবিক চিত্র দিয়ে এই পাথরের গতিশক্তি বুঝতে চাই, তাহলে এত অল্প সংখ্যক রাশি দিয়ে পরিমাপটা করা সম্ভব নয়।
কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কেন, এখানে সমস্যা কী? উত্তর হলো, পাথরে প্রায় অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যার (৬.০২×১০২৩) কাছাকাছি সংখ্যক অণু রয়েছে। পাথরের গতিশক্তি অবশ্যই এর ভেতরের সব অণুর গতিশক্তির যোগফলের সমান। প্রতিটি অণুর গতিশক্তি জানতে হলে আমাদের প্রতিটি অণুর ভর জানার পাশাপাশি প্রতিটির বেগের মানও জানতে হবে।
ধরা যাক, সব কটি অণু একরকম। তারপরও মোট গতিশক্তির মান জানতে গেলে আমাদেরকে প্রায় ১০২৩ সংখ্যক রাশি, অর্থাৎ প্রতিটি অণুর বেগের মান জানতে হবে। কিন্তু আমরা তো মাত্র দুটো রাশি দিয়েই এই একই শক্তি মেপে ফেললাম। তাহলে ধাঁধাটা কোথায়? একটু চিন্তা করলেই দেখতে পাব, পাথর যখন গতিশীল, তার প্রতিটি কণাই মোটামুটি একই বেগ নিয়ে চলছে। এর মান চলমান পাথরের বেগের সমান। ফলে এতগুলো বেগের পরিবর্তে আমরা মাত্র একটি বেগ দিয়েই পুরো পাথরের গতি বর্ণনা করতে পেরেছি। তার মানে, নিউটনীয় বর্ণনায় গতির ক্ষেত্রে সব কটি অণু আসলে সুশৃঙ্খল। একটি মাত্র অণুর বেগ জেনেই আমরা পুরো পাথরটির গতিবেগ জানতে পারছি। সেজন্য আমাদেরকে ১০২৩ টি বেগের মান জানতে হচ্ছে না।
এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, গ্যাসের ক্ষেত্রে কি এই চিত্রটি প্রযোজ্য? উত্তর—না! কারণ গ্যাসের অণুগুলোর ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত সবার গতি একরকম নয়। একেকটা অণু একেক দিকে যাচ্ছে। ফলে আগের চিত্র ব্যবহার করে পুরো গ্যাসের গতিশক্তি বের করতে গেলে আমাদের সব কটি অণুর গতিবেগ আমাদের জানতে হবে। এটা আদতে সম্ভব নয়, বিশেষ করে যেখানে অণুর সংখ্যা এত বড়।
তাই আমরা এই নিউটনীয় বর্ণনার পরিবর্তে তাপমাত্রার ধারণা নিয়ে আসি। এখান থেকে সবচেয়ে জরুরি যে জিনিসটা আমরা বুঝতে পারছি, সেটা হলো, তাপ বা তাপমাত্রা ইত্যাদির ধারণা, অণুর গতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু তাই নয়, এই গতিগুলোকে বিক্ষিপ্ত হতে হবে। অস্বীকার করব না, এই চিন্তাটা আমাদের পাঠ্যক্রমে বরাবরই রয়েছে।
কিন্তু আমার চোখ পড়ল, ৮ম বা ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে বলা হচ্ছে, তাপ তিনভাবে পরিচালিত হয়—এক, পরিবহন; দুই, পরিচলন ও তিন, বিকিরণ। প্রথম দুই পদ্ধতির সঙ্গে অণুর গতির সম্পৃক্ততা থাকলেও শেষ পদ্ধতির সঙ্গে অণুর গতিশক্তির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটা ফোটনের প্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে জন্য তাপের প্রবাহকে বিকিরণ বলা আসলে ভুল। হ্যাঁ, বিকিরণ শোষণ করে কোনো বস্তু উত্তপ্ত হতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে তাপ শোষণ করেছে।
একটা তুলনা দিয়ে আলোচনা শেষ করছি। আমরা মোবাইল ফোনে একে অন্যের সঙ্গে মনের ভাব আদান-প্রদান করি এবং সে জন্য আমরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি নিয়মিতই। কিন্তু মোবাইল ফোন নিজে কিন্তু শব্দ আদান-প্রদান করে না। বরং সেটা করে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে, যা কিনা ফোটনেরই সমাহার। সেটাও একধরনের (তড়িৎচৌম্বকীয়) বিকিরণ। তাহলে আমরা বিকিরণকে শব্দ সঞ্চালনের প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করব? অবশ্যই না। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে তাপ প্রবাহের এই ধারণা চালু ছিল এবং তা আমরা বাংলাদেশে জিইয়ে রাখছি, বিশেষ করে যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক দুই-ই মুখস্থনির্ভর শিক্ষার ধারক ও বাহক। এরকম আরেকটি বিষয় হলো আপেক্ষিক ভর, যা নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তার পাতায় আগে লিখেছি।
আমার মনে হয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের চিন্তা করার সময় হয়েছে—আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের কী শেখাচ্ছি, যা তারা ভবিষ্যতে এসে ভুল বলে জানবে। তারা যে ভুল শিখছে, সেটা যখন তারা উপলব্ধি করবে, তখন আমাদের ক্ষমা করবে কি না, তা জানি না।
এটা মাথায় রেখে বিজ্ঞানচিন্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, চিরায়ত শিক্ষাক্রমের বাইরেও বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও মতামত প্রকাশ করার সুযোগ তাঁরা করে দিচ্ছেন।
বিজ্ঞানচিন্তা দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক: কোচ, জাতীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দল এবং অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্স বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)
